শিল্প ও সাহিত্য গল্প

‘অপেক্ষার বৃষ্টি বকুল’।। সাদিয়া প্রমি। গল্প


নিউজরুম ডেস্ক
সোমবার, ২৭ জুলাই ২০২০ ইং ১৩:৫৮
NewsRoom


জ অনেক দিন পর ডায়েরির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বকুল ফুলের চেপ্টে যাওয়া পুরনো একটা মালা। একটু শুঁকে দেখলাম গন্ধটা আছে এখনো। ফুলের মালাটা উঠাতেই পরের পৃষ্ঠায় একটি চিঠি আর একটা তারিখ লেখা; ১৮-৬-২০১৮। চিঠির ভাজ খুলতেই দরজায় কড়া নেড়ে উঠল। ডায়েরিটা ড্রয়ারে রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখি গরম গরম চিড়ে ভাজা নিয়ে মা বলল, এই বৃষ্টির দিনে চিড়ে ভাজার কোন জবাব নেই।

একমুঠো চিড়ে হাতে নিয়ে মাকে বললাম, 
-আজ আষাঢ়ের কত তারিখ গো? 
মা বলল,
-দাঁড়া খবরের কাগজে দেখি। সঠিক খেয়াল নেই। 
চোখের চশমাটা ঠিক করে কাগজ দেখে মা বলল, 
-৬ তারিখ। 
আমার দিকে তাকিয়ে মা জানতে চাইল, হঠাৎ কেন বাংলা মাসের তারিখ জানতে চাইলাম।
-একটু হেঁসে বললাম, তেমন কিছুনা, এমনি।

বাসায় আজ আমি আর মা। বাবা বাইরে গেছে অফিসের কাজে। চিড়ে খাওয়া আর সঙ্গে এদিক-ওদিকের গল্প করতে করতে বাবা চলে এল।

-কি বাবা, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে আজ?
বাবা বলল, 
-হ্যাঁ, চলে এলাম আজ।

মা চলে গেল চিড়ের প্লেট নিয়ে। আমি ডায়েরিটা নিয়ে আবার বসলাম। চিঠিটার ভাঁজ না খুলে পড়তে আর ইচ্ছা হল না। গত ছয় মাসে কতবার যে খুলেছি চিঠিটা, পড়ার আর ইচ্ছেই নেই এখন।

মা বলল, আজ আষাঢ়ের ৬ তারিখ। আর কয়েকটা দিন গেলেই শ্রাবনের দিন আসবে; বর্ষার আসল রুপ তখন বোঝা যাবে। অবিরাম বৃষ্টি ঝরবে, হয়তো টানা দু'চারদিন। 

এইতো গত পরশু বাসায় আসার সময় ঝুম বৃষ্টি নামল। রিকশা পাইনি, ভিজতে হয়েছিল। বাসায় আসার পর মা ইচ্ছেমতো বকেছিল। অবশ্য বকারই কথা; যাবার সময় বার বার বলেছিল ছাতা নিয়ে যেতে, কিন্তু আমি নেইনি। যাক মায়ের বকা খাবার পর্ব শেষে কোনমতে একটু ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে আছি। ইয়ারফোনে গান বাজছে... 

 ''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি,
তোমায় দেখতে আমি পাইনি''

আজকের বৃষ্টিটা অন্যরকম। সকাল থেকেই থেমে থেমে ঝরছে। যখন ঝরে একটানা অনেকক্ষণ, আবার থামে; কিছুক্ষণ পর আবার। এ যেন হঠাৎ মন খারাপে ফুঁপিয়ে কাঁদা, সান্ত্বনায় থেমে যাওয়া নিরবতা; ব্যাথায় কাতরে উঠলে আরেক পশলা ঝরে পড়া কান্নার মতো। এজন্যই হয়তো কবিরা কবিতা বা বিভিন্ন লেখায় বলেছেন, প্রকৃতিমন আর মানবমন এক। মানব মনের বয়ে চলা চিন্তাধারা প্রকৃতির মাঝেই বিরাজমান।

একজন কবি বা গীতিকার কতো সুন্দর করেই না লিখেন। মনের সব ভাব প্রকাশ পায় তার কলমে। মনে হয় জগতের সব আকুলতা বের করে স্থান দিচ্ছেন গানের খাতায়। কি সুন্দর লাইন তাই না!

''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে''

লুকিয়ে রাখা সবকিছু আজকাল আমরা লুকাতে পারি না। সময়ের তাগিদে বা কোন এক ঝড়ে মনের আবেগে তাকে বের করতে হয়; সে যখন চলে যায় হৃদয় নিংড়ানো সব অনুভুতি তার দিকে ছুটে। আমরা বসে থাকি খালি হাতে। হিয়ার মাঝে কথাটাতে নিজের হিয়াকেই শূণ্য লাগে। খাঁচা ছাড়া পাখি মনে হয় না নিজেকে; আবদ্ধ লাগে। 

চোখ দুটো বুঝে আছি। আবারো বৃষ্টিতে আনমনা হয়ে কষ্ট নিয়ে ভাবছি, ফেলে আসা কোন এক স্মৃতি আর হিয়ার মধ্যে থাকা লুকোনো অনুভুতিকে জড়ো করতে। বৃষ্টির ছোঁয়াতে যদি একটু সজীব হয় তারা।

টেলিফোন বাজছিলো। রিসিভ করতেই অপরিচিত গলা। এই অপরিচিত গলাই আজ চরম পরিচিত। পরিচিত হয়েও হারিয়ে বেড়াচ্ছে অপরিচিতদের আঙিনায়।

-কি করছিস?
-কিছু না, বসে বসে বৃষ্টি দেখি; তুই?
-আমিও বৃষ্টিতে মিশিয়ে দিচ্ছি ক্লান্তিগুলো।
-ও…
-বের হবি কাল? পত্রিকা অফিসের লেখাটা আজ  জমা দিতে বলেছিল। ফোন দিয়ে বললাম বৃষ্টি অনেক কালকে আসি। উনারাও কালকের কথা বলল। তো বের হবিতো কাল..? হিয়া... শুনছিস?
-শুনছি, বল। দেখি কাল আসুক আগে।
-আচ্ছা।
-টেক কেয়ার, বাই।
-বাই।

কথা শেষ। রিসিভার রেখে আবারো বসলাম বৃষ্টি বিলাসে। ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে মুক্তোর দানা।

পত্রিকা অফিস যাব। বাইরে কালকের মতো বৃষ্টি না হলেও ইলশে গুড়ি বেশ ভালোই। ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। বের হবার সময় মা ছাতা ধরিয়ে দিলো আজ।

-হিয়া...

পিছন ফিরে দেখি অনিমেষ। একটা কালচে টি-শার্ট পড়েছে। যার অর্ধেকটাই বৃষ্টিতে ভিজে চিপচিপে হয়ে গেছে। হাতে একটা সবুজ শপিং ব্যাগ, আরেক হাতে ছাতা। বোধহয় আমারই মতো রিকশা পায়নি। ফোন দিয়ে নিজে ডাকলো বলে আসলাম, নইলে বিনা ডাকে সাড়া দেবার ইচ্ছা মরে গেছে বহু আগেই।

-দেরি হলো নাকি খুব?
-না ঠিক আছে, খুব একটা না। দেরি হলেও কি, অভ্যেস আছে।

একটু হেসে দিল। ছাতার পর্দায় টুক টুক বৃষ্টি ফোটার শব্দ আর অনির খিলখিলে হাসি। কেমন যেন এক সুন্দর মেলবন্ধন। হাসলে অনির গালে টোল পড়ে। সব ছেলেদের হয়তো সেটা থাকে না। খুব কম।

-কি? কই হারায় গেলি আবার।
-না, কিছু না। আচ্ছা শোন, রিকশা তো পাব না; হেঁটে যাব?
-হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে ভেজার চেয়ে হেঁটে রাস্তা কমানো ভালো। এইতো বড় রাস্তার উপর দিয়ে ১০ মিনিট হাঁটার পর পাশের ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পেরোলেই কাছেই। চলো পা চালাই।

হাঁটতে শুরু করলাম। বিদ্যুতের খুঁটির পাশে দাঁড় করানো ভ্যানে বসে আছে দুটো কাক। সকাল সকাল বৃষ্টিবিলাস বুঝি ওরাও করে। আমরা হেঁটে কাছে যেতে যেতে উড়ে গেল।

-আমি আজ ঘুম থেকে উঠেই অফিসে ফোন দিয়ে বলেছি আজকে আসব। সম্পাদক সাহেব যেন থাকে। তার সাথে কিছু কথা বলব।
-কি নিয়ে? 
-শোন হিয়া, সম্পাদকের যদি সময় হয়, উনি যদি ওনার কলামে আমাদের নিয়মিত করে নেন, তাহলে কাজ অনেক এগোবে।
-আমরা আমাদের মতো করে কাজটা উপস্থাপন করতে পারব, তাই না?
-হুম।

গত একমাস চলমান ঘটনাগুলোর উপর আমরা বিভিন্ন লেখা লিখছি। মোটামুটি একটা আর্টিকেলের মতো বেশ কবার ছেপে বের হয়েছে। লেখার মান ভালো হচ্ছে বলে পত্রিকা অফিস থেকে আবার ফোন দিয়ে ডেকেছে। অনির এক বন্ধু আছে ওখানে। তার সুবাদেই সব পাওয়া হচ্ছে।

অফিসে প্রায় এসে গেছি। বৃষ্টিতে ভেজা হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ে এল, হাতে কতগুলো বকুল ফুলের মালা।

-আপা নিবেন, কেবল বানাইছি। কি যে বাসনা। লন, দেহেন দেহেন।

মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে অনি বলল, দেতো দুটো। মেয়েটি অবাক হল না, মনে হচ্ছে সে জানতো অনি মালা নিবে। বলার সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে দিল। অনি ভেজা পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিতেই খুশিতে চকচক করে উঠল মেয়েটি। প্রাণখোলা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। 

আমি কিছু বলার আগেই আমার হাতে মালা দিয়ে বলে উঠল,

-নে রাখ, বকুল তোর পছন্দের না; রাখ।
-চল যাই ভেতরে।
আমি অবাক হইনি। কিন্তু কেন হইনি সেটা নিজেও জানি না।

অনির পেছন পেছন অফিসে গিয়ে কাজ সেরে ফেললাম। বের হব তখন আমায় বলল, 

-যাক কাজটা মিটে গেছে। টেনসনের কিছু নেই আর কি বল?
-হ্যাঁ, আপাতত কমল কিছু।
-চল ফিরে যাই।

ভেতরে ধক করে উঠল; মানে একসাথে বৃষ্টিতে হাঁটা কি শেষ! বাসা অবধি যাব না একসাথে। মনে মনে প্রশ্ন করে বসলাম। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলাম না।

-কি হল, চল।
-হ্যাঁ, যাচ্ছি।

বাসায় ফিরে ভেজা কাপড় ছেড়ে গা এলিয়ে বসলাম বারান্দায়। মুখের কাছে সরে আসা চুল হাত দিয়ে বিদায় করতে করতে কি সুন্দর একটা গন্ধ পেলাম নাকের কাছে; বকুল ফুল। উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের তাকে রাখা ফুলের মালাটা এলো খোঁপায় জড়িয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে এইতো অনি। আমায় যেন নিজে পরিয়ে দিল মালাটা। ধূসর ভাবনায় হঠাৎ মিলিয়ে গেল। আমিও ডায়েরির ভাজে রেখে দিলাম সুগন্ধভরা মালাখানি।

আজ ১৪-৬-২০২০। দিন চারেক পর মালাটা এখানে রাখার দু'বছর পূর্ণ হবে। দু'বছরে ফুলগুলোর আকারের পরিবর্তন হলেও গন্ধ আমার কাছে এখনো তাজা। মনে হচ্ছে কেউ যেন আশার বাণী দিয়ে গেছে। সেই আশাতেই আজও গন্ধটা সৌরভ ছড়াচ্ছে। আগেই বলেছিলাম, প্রাকৃতিক দৃশ্য, অবয়ব, সবই মানবমনের সাথে এক সুতোয় গাঁথা। ফুলও তো প্রকৃতিরই দান।

দিনগুলো আর অলস লাগে না। কেমন জানি জড় পদার্থে পরিণত হয়েছি। অনেকটা চুপসে যাওয়া মানসিকতা। নিজেকে কেন জানি কেন্দ্রিভুত করে রেখেছি। কিন্তু মা বাবা কখনো সেটা বুঝেছে কিনা জানি না। বাবার সাথে তো দিনে তেমন কথা হয় না। সারাবেলা স্টাডিরুম, মিটিং, প্রজেক্ট এগুলোই। কিন্তু কাছে গেলে একদম সময় দেন না এমন না। মা আছে গানের ক্লাস, স্টুডেন্ট, মহিলা সমিতির বিভিন্ন কাজে। এখন তার ব্যস্ততা অনেকটা কম। সেক্রেটারি সব গুছিয়ে নেন। মা একটু দিক নির্দেশনা দিলেই হয়। আমি ভার্সিটি যাই, ক্লাস করি, কোর্সের প্রজেক্ট রেডি করি, এটুকুই। আর একলা নিরবতায় নিজের সঙ্গী নিজেই।

একটা ডাক পড়ল।
-হিয়া এদিকে আয় তো, তোর ফোন এসেছে।
-আসছি মা।

নিচে নেমে দেখি রিসিভার নামানো। মা কাজ করছেন। চশমাটা চোখে দিতে দিতে আমার দিকে না তাকিয়েই ইশারায় বললেন ফোন ধরতে।

আমি হ্যালো বলতে যাবো...
-হিয়া।

আমি আকাশ পাতাল চিন্তা করতে পারলাম না। ডাক শুনে মনে হচ্ছে কত বছরের অপেক্ষার পর কেউ চমকে দিয়ে ধারালো ছুরি বসিয়ে দিল বুকে। ঝরঝরিয়ে রক্ত পড়ছে, কিন্তু যন্ত্রণা আমি বুঝতে পারছি না। বিষে ভরা রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। আর পুরো দেহে শান্তির মোলায়েম অনুভূতি।

-চিনতে পারলি? হ্যালো... হ্যালো...

থমকে গিয়ে ঢোক গিলে বললাম, 

-হ্যাঁ, কেমন আছিস?
-ভালো, আমি দেশে ফিরছি পরশু। পরে রাজশাহী গিয়ে থাকব দু'দিন।

আরেকটা ঝটকা খেলাম। কিন্তু রক্তাক্ত ঘা এখন আর মনে হচ্ছে না। শ্রবনশক্তি অবশ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না। আর কি বলে যাব সেটাও বুঝে উঠতে পারছি না।

-কিরে বলছিস না কেন কিছু? হ্যালো... হ্যালো... হিয়া... হ্যালো, হিয়া আছিস লাইনে?
-ভালো লাগল শুনে আসছিস যে।
-আরে বাবা আসছি বললে তো সবাই খুশি হয়। আমি বলছি তুই কি ফ্রি আছিস? দেখা করব তোর সাথে। অবশ্য ফ্রি না থাকলেও তোকে দেখা করতেই হবে।

এমনভাবে জোর দিয়ে কথাটা বলল যেন হাজার বছরের দাবি রাখি আমি এ জোরটার। শিকল পড়া আমি কথা শুনতে বাধ্য যেন। 

-রাখছি। এসে কথা হবে, টাটা।
-হুম, বাই।

-কে রে ফোন দিল?
মায়ের প্রশ্নে চেতন ফিরে পেলাম।

-না, ওই অনি আরকি।
-ওহ। গত না তার আগের বছরই না কানাডা গেল। বেশ ভালো খাটাখাটনি করেছে, মেধা ধরে অনেক।
-হুম।
-তা কি বলল; প্রশ্নটা করার আগেই আমি বলে দিলাম, 'মা ঘরে গেলাম, কিছু লাগলে ডেকে নিও।'
-আচ্ছা।

সিড়িতে পা দিয়ে উঠতে লাগলাম আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে কিছু একটা পাওয়া না পাওয়ার অনেকগুলো ধাপ এগোচ্ছি। আদৌ পাবার কোন আশা আছে কি। সা সংশয়ে আছি। সামনের সোপানগুলো আরো বেঁকে যাচ্ছে। আর আমিও হেলছি।

ঘরে গিয়ে ডায়েরিটা নিলাম। চিঠির ভাজ খুলে পড়তে শুরু করলাম।

...প্রিয় হিয়ারানী...
কি করছিস? অপেক্ষা?

এর বেশি পড়তে পারিনি, রেখে দিলাম। "অপেক্ষা" শব্দেই বিশাল ক্লান্তি আমার। এক টুকরো কাগজের চিঠির ভার এত কেন নিজেই বুঝি না। ভেতরটাও ভারী হয়ে আসে। আর পাঁজরের প্রতিটা কোণায় "অপেক্ষা" কথাটার প্রতিধ্বনি বাজতে থাকে। 

ডায়েরিটা বালিশের উপর রেখে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। এটাই কি আমি। আমি কি আমার হিয়াকে দেখতে পাচ্ছি? দু'বছর না, গত তিনটা বছর ধরে নিজের ভেতরের আমিটাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করিনি। ধূসর চোখে একটা বাড়ানো হাতে একটা মলিন বকুল ফুলের মালার ছবি দেখছি। 

চোখের কোণা থেকে এক ফোঁটা পানি ঝড়ল। নিচে বসে সেই ফোঁটার মধ্যে তাকিয়ে রইলাম; একটা সাগর দেখতে পাচ্ছি, সাগরের তীরে বেদনার নীল শাড়ি পড়ে একা হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে হাতটা ঝাপটে ধরল একটা হাত। অনি!

''কোথায় যাচ্ছিস?
চল বালুকাবেলায় একসাথে হাঁটি
একসাথে দেখব সূর্যের বাড়ি ফেরা।''

মুখফুটে বলতে পারলাম না কিছু। কাঁধে মাথা জড়িয়ে দেখতে থাকলাম পশ্চিম আকাশে লালচে আভা মিশে গেল পুরো আকাশে। ঢেউয়ের হাওয়া মন শীতল করে দিল।

আমার দোষ এটাই কাউকে কিছু বলতে পারিনা। নিজের মনের কথাগুলো নিজের মধ্যেই ডালপালা গজিয়ে ওঠে। তার প্রতিটি পাতায় আলাদা আলাদা ছন্দ। ছন্দ আলাদা হলেও গাছের মূল কান্ড একটাই। যার ছায়াতলে বসে আজ আমি কি যেন পাওয়ার আশায় পথ চেয়ে আছি।

একটা হালকা নীল রংয়ের থ্রিপিস পড়লাম। কপালে ছোট কালো টিপ। নীল রঙ অনির প্রিয়। আর কি কি ওর প্রিয় সেটা সবই প্রায় আমার জানা। কিন্তু আমি কি অনির প্রিয়? এটা আজও জানা হল না। জানতে চাওয়ার চেষ্টাও যে করিনি তা নয়। কিন্তু আমিতো ভেতরমনা। আমার ভেতরেই রয়ে গেছে সেটার উত্তর। আচ্ছা অনি কি সেটা বুঝতে পারে? নাকি আমাকেও বুঝে না।

বেরিয়ে যাব। মা বলল, ছাতা নিয়ে যা; মেঘ কালো করেছে। নেয়ার ইচ্ছে ছিল না। মায়ের জোরাজুরিতে নিলাম ছাতা।

কাজলা গেট পার করে হাঁটতে থাকলাম। কি জানি প্রতিটি কদমে আজ "অপেক্ষা" নামক শব্দ ধপ ধপ করে বাড়ছে। সময় কি বাড়ছে না কমছে সেটাও মনে হচ্ছে না। পাশ দিয়ে ঝরের গতিতে একটি কালো রঙের গাড়ি এসে থামল। শিউরে উঠলাম। মুখ ঝামটা দেবার আগের মুহুর্তেই কপাল কুঁচ হয়ে যায়। আর বলার আগেই বেরিয়ে এল অনি। বোবা হয়ে গেলাম। বোবা দৃষ্টি আমার। বোবা অনুভুতি। মাথায় চাটি মেরে বলল,

-কিরে হিয়ারানী। বেশ পন্ডিত হয়েছিস হয়েছিস লাগে। 
-কেমন আছিস?
-বাহ, ফরমালিটি দেখাচ্ছিস নাকি। হেসে উঠল অনি।
-ফরমালিটি দেখাবো কেন। সে দায় তো আমার না। তা ভালো গাড়ি কিনেছিস। বেশ বেশ।
-হ্যাঁ, কিনে ফেললাম। হ্যারে তোর মধ্যে দু'বছরে পরিবর্তন তো দেখলাম না।

নিজের ভেতরের নিজেকে প্রশ্ন করলাম 'একই আছি?' আমার ভেতরের পরিবর্তন বোধহয় এতদিন পরে আর প্রকাশিত হচ্ছে না। কি অদ্ভুত!

-চল তোকে নিয়ে ঘুরতে যাই। অনেকদিন দেশের মাটির হাওয়া লাগে না।
-কেন হাওয়া লাগিয়েইতো ঘুরে এলি।
-আরে ওগুলো সব গুমোট হাওয়া, বিষাক্ত। আর এখন কি তুই আছিস তো; এয়ারফ্রেশনার। চলতো কথা বাড়াস নে।

ঠিক আগের মতো হাতে টান দিয়ে বলল, 

-বস ভেতরে, আজকে শহর ঘুরব।

আমি কথা না বলে মুচকি হেসে বসলাম।

-গুড গার্ল।'

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পর একের পর এক কথা শুনে যাচ্ছি ওর; বিদেশের কথা, কাজের চাপ, সাফল্য। খুব ভালো লাগছে। কাছের মানুষের ছোট বড় সব এচিভমেন্টই খুব প্রশান্তি দেয়।

আরেকটা প্রশ্ন 'কাছের মানুষ?' অনিকে মনের অজান্তে কাছের মানুষ বলে দিলাম? আচ্ছা, ও কি ভাবে আমায় ওর কাছের মানুষ?

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শহরের রাস্তা ছেড়ে খোলা রাস্তায় এসে গাড়ি চলছে। কাঁচ নামিয়ে দিলাম। ঝাপটা লাগছে মুখে শীতল অনুভুতি। ভেজা মাটির গন্ধে আজ বকুল ফুলেরই গন্ধ মিশে।

-ঠান্ডা লেগে যাবে।
-না লাগবে না, ঠান্ডা লাগার ভয়ে আজ গুটিয়ে নিলে নিজ বেদনাকে স্পর্শ করবো কীভাবে।
-ভিজবি?
আমি জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বললাম,
-হ্যাঁ।
অমনি গাড়ি থেমে গেল। অনি বাইরে বেরিয়ে বলল, 'আয় বাইরে।'

আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। বেরিয়ে গেলাম। সামনে সবুজ একটা মাঠ। কতগুলো বাচ্চা ছেলে ফুটবল খেলছে। অনি দৌড়ে গেল। বাচ্চাদের সাথে মিশে খেলতে লাগল। বরাবারের মতো চঞ্চল স্বভাবটা ওর রয়েই গেছে। মানুষ মনখোলা প্রফুল্ল হলে তাদের স্বভাব বদলায় না। আজ অনিকে দেখে খুব ভালো বুঝতে পারছি।

আমি উপরে তাকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাসে নিজের ভেতরের বিষাক্ত হাওয়া ছেড়ে দিয়ে মিশতে চাচ্ছি প্রকৃতিতে। বৃষ্টির সাথে নিজের দু'ফোঁটা অশ্রুও মিশিয়ে দিলাম। অনি দেখতে পায়নি। দেখলে হয়তো বকতো খুব। ওর চঞ্চলতা দেখে যাচ্ছি। হঠাৎ খেলা ছেড়ে এগিয়ে এল।

-অনেকদিন পর দেশের আমেজ পেয়ে নিজেকে আটকাতে পারলাম নারে।
মুচকি হাসলাম।
-কি রে হিয়া? বেশ সুন্দর লাগছে তোকে। নীলে মানায় ভালো।
-তাই!
-হ্যাঁ, নীল আর সবুজের একটা সীমানা থাকে জানিস তো...
-হ্যাঁ, জানি। সবুজের শেষ যেখানে নীলের শুরু সেখানে।
-যেমন এই মাঠ। সবুজে ঘেরা। সামনে নীল আকাশের সাথে মিলে গেছে। শুরু হয়েছে নীলের যাত্রা। যদিও এখন মেঘে ঢাকা কালো মেঘ সরে গেলেই আবার লুকিয়ে থাকা আসল সত্য প্রকাশিত হবে।
-বাহ, দারুন বলেছিস তো। সামনে কবি হবার সমূহ সম্ভাবনা দেখছি তোর।

একটু শব্দ করে হেসে উঠলাম।
-যাহ কি বলিস, এসব কিছু না।
দেখলাম আমার হাসির দিকে এখনো তাকিয়ে আছে অনি। চোখে চোখ পড়তে সামলে নিলাম নিজেকে। বলে উঠল, 
-চল বেশিক্ষণ ভিজলে কালকে হাসপাতালে শুতে হবে তোর। গাড়িতে ওঠ।

উঠে বসলাম সারা রাস্তা কথা হল খুব কম। বৃষ্টি দেখতে দেখতে চলে এলাম। বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,

-শোন, কাল পদ্মার পাড়ে যাবো। ক্লাস শেষে অপেক্ষা করিস।

আবারো অপেক্ষা...

-যাবি তো?
-হু, যাব।
-আচ্ছা যা, বাই।

কালো গাড়ি, কালো আঁধারে মিলিয়ে গেল। আমিও কিছুটা সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম।

ভেঁজা কাপড় ছেড়ে সন্ধ্যার পাখিদের ঘরে ফেরা দেখা হয়নি আজ। কিন্তু মনের ভেতরের পাখিটাকে কালো আঁধারে মিশে যেতে দেখেছি। টেবিলে বসে লাল কলমে কাগজে হিজিবিজি লিখে যাচ্ছি। লম্বা লম্বা দাগ টানছি। কাউকে কখনো চিঠি লেখা হয়নি, যা হয়েছিল সেটারও উত্তর পাইনি আজও। কিন্তু  ফিরতি চিঠির ভাষা আজও পড়তে পারিনি। 

পরদিন ক্লাস শেষ। দাঁড়িয়ে আছি। অনেক্ষন হল অনি এল না। ফোনও আনিনি আজ; চার্জ শেষ, বাসায় ভুলে ফেলে আসছি। অপেক্ষার প্রহর বরাবরের মতোই শেষ। অনি আজ আর আসেনি। ফিরে গেলাম নীড়ে ফেরা পাখির মতো। আজও হয়তো আসবে না, চঞ্চলতার মতো খামখেয়ালি ভাবটাও কি ধরে রেখেছে অনি। বিদেশে যাবার আগেও ক্লাস শেষে কত দাঁড়িয়েছি ওর অপেক্ষায়; আসেনি। আজ আর সেই অপেক্ষার কোন ক্লান্তি নেই; আমি অভ্যস্ত, চিরচেনা অপেক্ষার গ্রাসে তলিয়ে গেছি আমি।

ফোনে মেসেজ আসল। নোটিফিকেশন শব্দ শুনেই বুঝে গেলাম মেসেজের ভাষা; ''সরি হিয়া, জানিসই বরাবরের ভুলোমন। চাপে পড়ে গেছি। কাল মাস্ট দেখা হবে। সরিইইই।'' 

তাই, না পড়া চিঠিটার মতোই মেসেজটাও না পড়াই রইলো। সবইতে অভ্যস্ত আজ আমি।

কতশত বারের মতো এখনো খামখেয়ালি অনি। কিন্তু নিজের পরিবারে মা ছাড়া যখন কোন অবলম্বন ছিলো না, মাকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াসে ব্যস্ত। কি কি কঠিন দিন পার করেছে দেখেছি। টিউশনি করতো, পত্রিকা অফিসে লেখা জমা দিত; আমিও দিতাম, কিন্তু অনির চেষ্টা খুব বেশি। কতকত স্কলারশিপের চেষ্টা করেছে। সাইন্সের প্রতিটা বিষয়ে খুব ভালো দক্ষতা রাখত। কতকত লেখালিখিও করেছে। অবশেষে ওর লেখা একটা আর্টিক্যাল পাবলিশ হল; স্কলারশিপও পেয়ে গেল। চলেও গেল। আজ পড়াশুনা আর কর্মক্ষেত্র দু'দিকেই খুব উন্নতি করেছে। যাবার পর কথা হত মাঝে মাঝে। কিন্তু আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করল।

নিজের মনের কথা, ভেতরের অনুভুতি কখনো ওকে সবটা বলতে পারিনি। ওই যে আগেই বলেছি, আমি ভেতরমনা। সহজে কিছু প্রকাশ করতে পারি না। পাছে বন্ধুত্বটা ভেঙে যাক এই ভয়ে। আজও হয়তো পারব না ওকে সবটা বলতে। একটা চিঠি দিয়েছিলাম অনেক সাহস করে, কিন্তু সেটার উত্তর আসেনি কখনো। হয়তো আমাকে বললে আমি কষ্ট পেতাম সেজন্য মুখফুটে বলেনি কখনো। আমিও আর প্রসঙ্গ তুলিনি কখনো। ও বিদেশে যাবার পর আমার ঠিকানায় চিঠি আসে একটি। কিন্তু সে চিঠি আজও খুলে দেখার সাহস হয়নি। কারণ, যদি আমার আশার বাতিতে জল পড়ে নিভে যায়; সেই ভয়ে। গত ছ'মাসে কতবার হাতে নিয়েছি পড়ব বলে, কিন্তু সাহস এসেই কোথায় নিমিষে পালিয়ে যায়।

এলার্ম দেয়া ছিল ফোনে, হুট করে বেজে উঠল। বন্ধ করে দিলাম। হয়তো ঘুম যাবার কথা ছিল সে ভেবে দেয়া, কিন্তু নির্ঘুম এই আমি যে আর নিদ্রা যাই না। মেসেজটা চোখে পড়ল। কিন্তু যা ভেবেছিলাম সেরকম না। এই প্রথম হয়তো অনির বিষয়ে একটা ভাবনা আমাকে ছাড়িয়ে গেল। আজ লেখাটা আগের স্ট্রাকচারটাকে ছাড়িয়ে গেছে।


- কীভাবে নিবি কথাটা জানিনা হিয়া। কিন্তু তোর জন্য আমার মনের আবেগটা আগের মতোই রয়েছে। আমি তোকে চিঠি লিখেছিলাম। তুই হয়তো পড়েছিস কি পড়িসনি জানিনা। আর সেই চিঠির উত্তর কখনো পাইনি, নিজেও জানতে চাইনি। কারণ তোর মনের উপর স্বাধীনতা শুধু তোরই। আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য হয়তো তোর মনের মধ্যে আকুলতা আমারই মতো, কিন্তু চিঠির উত্তর না পেয়ে মুছড়ে পড়েছিলাম। এখন যতটা কাছাকাছি আছি সেটাও যদি হারিয়ে যায় সে ভয়ে তোকে প্রশ্ন করা হয়নি। সেই বকুলের মালাটা আজও রেখেছিস দেখলাম। পত্রিকা অফিসের সামনে দিয়েছিলাম যে...

মেসেজ পড়া থামিয়ে দিলাম। দৌড়ে গেলাম, ব্যাগ খুলে দেখি ডায়েরিটা নেই। বিছানায় বসে পড়লাম। আবারও মেসেজে মন দিলাম,

''কিরে কথাটা শুনে চমকে গেছিস। ডায়েরিটা খুঁজতে শুরু করেছিস। তোর ডায়েরি আমার কাছে। সেদিন গাড়িতে বেখেয়ালে ফেলে গেছিস। ভাগ্যিস ফেলে গিয়েছিলি, তোর এই বেখেয়ালি স্বভাবটার জন্য আজ মনের মধ্যে পুরনো ভালোবাসাটা আরেকটবার হাতছানি দিল।

আমার মনের সব কথা চিঠিতে লিখেছিলাম। কারণ তখন হয়তো তোর চোখ দেখে তোর মনের কথাটা পড়তে পেরেছিলাম। কিন্তু, আমার পরিস্থিতি ছিল অন্য; বুকে হাজার স্বপ্ন,  মাথার উপর কিছু দায়িত্ব। চাইলেও তখন তোর দিকে হাত বাড়াতে পারতাম না। সব জানিয়েছিলাম তোকে। হয়তো আমার মতো শঙ্কায় পড়ে তুইও পড়িসনি চিঠি। আমি ভেবেছিলাম সময় পাল্টে যাবে; আর তুইও পাল্টে যাবি। প্রণয়ের দিকে এগোবে না মনের ভেতরের আবেগটা।

কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তুই বদলাসনি। বৃষ্টির মতো তোর চোখেও বিচ্ছেদের করুণ ছবি ভেসে ওঠে। তোর বাড়িয়ে রাখা হাতটা আমি ধরতে চাই, সুযোগ দিবি তো আমায়...''


থেমে গেল আমার মেসেজ পড়া। মনের ভেতর হাজারটা প্রজাপতির ডানা ঝাপটানো বুঝতে পারছি, ঝড় উঠেছে যে কীভাবে থামাবো তা? আজ বুঝি মনের ভেতরে উথাল পাতাল হচ্ছে সব। এত বছর নিজের মধ্যে নিজের ভরসাটার সাথে লড়াই করেছি অনেক। সত্যিই কি হাত বাড়াচ্ছে অনি আমার দিকে, নাকি বাড়ানো হাতটা কালো গাড়ির মতোই ধূসর অন্ধকারে হারিয়ে যাবে... কল্পনা সব আমার!

সকাল সকাল রেডি হলাম। আজকে প্রজেক্ট জমা দিব। প্রজেক্ট জমা দেওয়ার তাড়া নেই মনে। তবুও কি যেন একটা থেকে ঘন্টা বাজাচ্ছে। কানে তালা লেগে যাচ্ছে সে আওয়াজে। কিন্তু তাও দু'হাতে তো কান চেপে ধরছি না। কি জানি চলছে একটা...

প্রজেক্ট শেষ করে বকুলতলা দিয়ে হাঁটছি। কি সুন্দর ফুলগুলো ঝরে থাকে। সাদা তারার মতো ছড়ানো। মনে হচ্ছে একরাশ নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে মাটিতে। তুলে নিয়ে অনুভব করলাম কিছু বকুলের সুবাস। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খুলতেই দেখি দূরে অনি দাঁড়িয়ে। একটা কালো টি-শার্ট পড়েছে। কালো রঙে ছেলেদের ভালোই মানায়। চিরচেনা এই রঙে বহুবার দেখেছি অনিকে। আজকে কেন জানি এক নতুন মানুষ লাগছে। এগিয়ে এল সামনে। ওর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন আমার ভেতরে ঠাস ঠাস শব্দে শব্দ হচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। কিন্তু কেন! আগে তো এমন অনুভুতি কখনো হয়নি...

-হাতটা দেখি?
-হু?
-বলছি হাতটা দে তোর। 
-বাধ্য শিশুরমতো বাড়ালাম।
-চোখ বন্ধ কর। 
-হু।
একটা ভারী কিছু অনুভব করলাম।
-চোখ খোল।
-ডায়েরি?
-হ্যাঁ, তোর ডায়েরি। তোর মনের কথা পড়তে না পারলে হয়তো আজও সব অধরাই থেকে যেত। 
-কিছু কিছু জিনিস অধরা থাকাই ভালো। এত বছর তো সব অধরাই ছিল। অনুভবে সব ছিল জীবন্ত, রঙিন।-
হুম, আজও আবার সব রঙিন হবে; হবে তুই যেমন চাইতি। 
-মানে?
মানে কিছুই না।

মাথা নিচু করে আছি। ডায়েরিটা বেখেয়ালে খুলে দেখলাম, একটি নতুন বকুল ফুলের মালা আর কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি। চোখ তুলে তাকাতেই দেখি অনি হাসছে। 

-পুরনোটা ফেলে দিয়েছি। পুরনো কেবল বেদনাই বাড়ায়।
কিরে পাগলি কাঁদছিস কেন?
ওই! কিরে...

এমন সময় হুরমুড়িয়ে বৃষ্টি শুরু। আমার অশ্রুজল আর বৃষ্টিজল মিশে যাচ্ছে। সকাল থেকেই যদিও আকাশ কালো ছিল। আমি আজও বেখেয়ালে ছাতা আনিনি। মাথার উপর ছাতা ধরল অনি। আর বকুল ফুলের ছড়ানো পথ ধরে এগিয়ে চললাম।

আজকের বৃষ্টি আর বৃষ্টি বকুল, সবাই নতুন সৌরভ দিচ্ছে। 

''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিল''

আজ আমি তারে পেয়েছি। তার বকুলের মালার মতো করে অনুভব করছি ঝরে পড়া বৃষ্টির ঝাপটা।

পৃথিবীর সবকিছুতে একটা সুর আছে; শুধু বুঝে নিতে হয়। আর নিজের ভেতরে থাকা সৌরভ সবসময় অনুভব করতে হয়। বাড়ানো হাত বাড়িয়ে রাখল ভরসার মানুষটি। একটা না একটা সময় ধরবে সে হাত। 

আর তখন ছড়াবে,

বকুলের মতো সুবাস আর ঝরবে অঝোরে মোহনীয় বৃষ্টি।


সাদিয়া প্রমি
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

আপনার মতামত লিখুন :

ডেটায় দেশ

শিল্প ও সাহিত্য গল্প

‘অপেক্ষার বৃষ্টি বকুল’।। সাদিয়া প্রমি। গল্প


নিউজরুম ডেস্ক
সোমবার, ২৭ জুলাই ২০২০ ইং ১৩:৫৮
NewsRoom


জ অনেক দিন পর ডায়েরির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বকুল ফুলের চেপ্টে যাওয়া পুরনো একটা মালা। একটু শুঁকে দেখলাম গন্ধটা আছে এখনো। ফুলের মালাটা উঠাতেই পরের পৃষ্ঠায় একটি চিঠি আর একটা তারিখ লেখা; ১৮-৬-২০১৮। চিঠির ভাজ খুলতেই দরজায় কড়া নেড়ে উঠল। ডায়েরিটা ড্রয়ারে রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখি গরম গরম চিড়ে ভাজা নিয়ে মা বলল, এই বৃষ্টির দিনে চিড়ে ভাজার কোন জবাব নেই।

একমুঠো চিড়ে হাতে নিয়ে মাকে বললাম, 
-আজ আষাঢ়ের কত তারিখ গো? 
মা বলল,
-দাঁড়া খবরের কাগজে দেখি। সঠিক খেয়াল নেই। 
চোখের চশমাটা ঠিক করে কাগজ দেখে মা বলল, 
-৬ তারিখ। 
আমার দিকে তাকিয়ে মা জানতে চাইল, হঠাৎ কেন বাংলা মাসের তারিখ জানতে চাইলাম।
-একটু হেঁসে বললাম, তেমন কিছুনা, এমনি।

বাসায় আজ আমি আর মা। বাবা বাইরে গেছে অফিসের কাজে। চিড়ে খাওয়া আর সঙ্গে এদিক-ওদিকের গল্প করতে করতে বাবা চলে এল।

-কি বাবা, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে আজ?
বাবা বলল, 
-হ্যাঁ, চলে এলাম আজ।

মা চলে গেল চিড়ের প্লেট নিয়ে। আমি ডায়েরিটা নিয়ে আবার বসলাম। চিঠিটার ভাঁজ না খুলে পড়তে আর ইচ্ছা হল না। গত ছয় মাসে কতবার যে খুলেছি চিঠিটা, পড়ার আর ইচ্ছেই নেই এখন।

মা বলল, আজ আষাঢ়ের ৬ তারিখ। আর কয়েকটা দিন গেলেই শ্রাবনের দিন আসবে; বর্ষার আসল রুপ তখন বোঝা যাবে। অবিরাম বৃষ্টি ঝরবে, হয়তো টানা দু'চারদিন। 

এইতো গত পরশু বাসায় আসার সময় ঝুম বৃষ্টি নামল। রিকশা পাইনি, ভিজতে হয়েছিল। বাসায় আসার পর মা ইচ্ছেমতো বকেছিল। অবশ্য বকারই কথা; যাবার সময় বার বার বলেছিল ছাতা নিয়ে যেতে, কিন্তু আমি নেইনি। যাক মায়ের বকা খাবার পর্ব শেষে কোনমতে একটু ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে আছি। ইয়ারফোনে গান বাজছে... 

 ''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি,
তোমায় দেখতে আমি পাইনি''

আজকের বৃষ্টিটা অন্যরকম। সকাল থেকেই থেমে থেমে ঝরছে। যখন ঝরে একটানা অনেকক্ষণ, আবার থামে; কিছুক্ষণ পর আবার। এ যেন হঠাৎ মন খারাপে ফুঁপিয়ে কাঁদা, সান্ত্বনায় থেমে যাওয়া নিরবতা; ব্যাথায় কাতরে উঠলে আরেক পশলা ঝরে পড়া কান্নার মতো। এজন্যই হয়তো কবিরা কবিতা বা বিভিন্ন লেখায় বলেছেন, প্রকৃতিমন আর মানবমন এক। মানব মনের বয়ে চলা চিন্তাধারা প্রকৃতির মাঝেই বিরাজমান।

একজন কবি বা গীতিকার কতো সুন্দর করেই না লিখেন। মনের সব ভাব প্রকাশ পায় তার কলমে। মনে হয় জগতের সব আকুলতা বের করে স্থান দিচ্ছেন গানের খাতায়। কি সুন্দর লাইন তাই না!

''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে''

লুকিয়ে রাখা সবকিছু আজকাল আমরা লুকাতে পারি না। সময়ের তাগিদে বা কোন এক ঝড়ে মনের আবেগে তাকে বের করতে হয়; সে যখন চলে যায় হৃদয় নিংড়ানো সব অনুভুতি তার দিকে ছুটে। আমরা বসে থাকি খালি হাতে। হিয়ার মাঝে কথাটাতে নিজের হিয়াকেই শূণ্য লাগে। খাঁচা ছাড়া পাখি মনে হয় না নিজেকে; আবদ্ধ লাগে। 

চোখ দুটো বুঝে আছি। আবারো বৃষ্টিতে আনমনা হয়ে কষ্ট নিয়ে ভাবছি, ফেলে আসা কোন এক স্মৃতি আর হিয়ার মধ্যে থাকা লুকোনো অনুভুতিকে জড়ো করতে। বৃষ্টির ছোঁয়াতে যদি একটু সজীব হয় তারা।

টেলিফোন বাজছিলো। রিসিভ করতেই অপরিচিত গলা। এই অপরিচিত গলাই আজ চরম পরিচিত। পরিচিত হয়েও হারিয়ে বেড়াচ্ছে অপরিচিতদের আঙিনায়।

-কি করছিস?
-কিছু না, বসে বসে বৃষ্টি দেখি; তুই?
-আমিও বৃষ্টিতে মিশিয়ে দিচ্ছি ক্লান্তিগুলো।
-ও…
-বের হবি কাল? পত্রিকা অফিসের লেখাটা আজ  জমা দিতে বলেছিল। ফোন দিয়ে বললাম বৃষ্টি অনেক কালকে আসি। উনারাও কালকের কথা বলল। তো বের হবিতো কাল..? হিয়া... শুনছিস?
-শুনছি, বল। দেখি কাল আসুক আগে।
-আচ্ছা।
-টেক কেয়ার, বাই।
-বাই।

কথা শেষ। রিসিভার রেখে আবারো বসলাম বৃষ্টি বিলাসে। ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে মুক্তোর দানা।

পত্রিকা অফিস যাব। বাইরে কালকের মতো বৃষ্টি না হলেও ইলশে গুড়ি বেশ ভালোই। ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। বের হবার সময় মা ছাতা ধরিয়ে দিলো আজ।

-হিয়া...

পিছন ফিরে দেখি অনিমেষ। একটা কালচে টি-শার্ট পড়েছে। যার অর্ধেকটাই বৃষ্টিতে ভিজে চিপচিপে হয়ে গেছে। হাতে একটা সবুজ শপিং ব্যাগ, আরেক হাতে ছাতা। বোধহয় আমারই মতো রিকশা পায়নি। ফোন দিয়ে নিজে ডাকলো বলে আসলাম, নইলে বিনা ডাকে সাড়া দেবার ইচ্ছা মরে গেছে বহু আগেই।

-দেরি হলো নাকি খুব?
-না ঠিক আছে, খুব একটা না। দেরি হলেও কি, অভ্যেস আছে।

একটু হেসে দিল। ছাতার পর্দায় টুক টুক বৃষ্টি ফোটার শব্দ আর অনির খিলখিলে হাসি। কেমন যেন এক সুন্দর মেলবন্ধন। হাসলে অনির গালে টোল পড়ে। সব ছেলেদের হয়তো সেটা থাকে না। খুব কম।

-কি? কই হারায় গেলি আবার।
-না, কিছু না। আচ্ছা শোন, রিকশা তো পাব না; হেঁটে যাব?
-হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে ভেজার চেয়ে হেঁটে রাস্তা কমানো ভালো। এইতো বড় রাস্তার উপর দিয়ে ১০ মিনিট হাঁটার পর পাশের ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পেরোলেই কাছেই। চলো পা চালাই।

হাঁটতে শুরু করলাম। বিদ্যুতের খুঁটির পাশে দাঁড় করানো ভ্যানে বসে আছে দুটো কাক। সকাল সকাল বৃষ্টিবিলাস বুঝি ওরাও করে। আমরা হেঁটে কাছে যেতে যেতে উড়ে গেল।

-আমি আজ ঘুম থেকে উঠেই অফিসে ফোন দিয়ে বলেছি আজকে আসব। সম্পাদক সাহেব যেন থাকে। তার সাথে কিছু কথা বলব।
-কি নিয়ে? 
-শোন হিয়া, সম্পাদকের যদি সময় হয়, উনি যদি ওনার কলামে আমাদের নিয়মিত করে নেন, তাহলে কাজ অনেক এগোবে।
-আমরা আমাদের মতো করে কাজটা উপস্থাপন করতে পারব, তাই না?
-হুম।

গত একমাস চলমান ঘটনাগুলোর উপর আমরা বিভিন্ন লেখা লিখছি। মোটামুটি একটা আর্টিকেলের মতো বেশ কবার ছেপে বের হয়েছে। লেখার মান ভালো হচ্ছে বলে পত্রিকা অফিস থেকে আবার ফোন দিয়ে ডেকেছে। অনির এক বন্ধু আছে ওখানে। তার সুবাদেই সব পাওয়া হচ্ছে।

অফিসে প্রায় এসে গেছি। বৃষ্টিতে ভেজা হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ে এল, হাতে কতগুলো বকুল ফুলের মালা।

-আপা নিবেন, কেবল বানাইছি। কি যে বাসনা। লন, দেহেন দেহেন।

মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে অনি বলল, দেতো দুটো। মেয়েটি অবাক হল না, মনে হচ্ছে সে জানতো অনি মালা নিবে। বলার সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে দিল। অনি ভেজা পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিতেই খুশিতে চকচক করে উঠল মেয়েটি। প্রাণখোলা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। 

আমি কিছু বলার আগেই আমার হাতে মালা দিয়ে বলে উঠল,

-নে রাখ, বকুল তোর পছন্দের না; রাখ।
-চল যাই ভেতরে।
আমি অবাক হইনি। কিন্তু কেন হইনি সেটা নিজেও জানি না।

অনির পেছন পেছন অফিসে গিয়ে কাজ সেরে ফেললাম। বের হব তখন আমায় বলল, 

-যাক কাজটা মিটে গেছে। টেনসনের কিছু নেই আর কি বল?
-হ্যাঁ, আপাতত কমল কিছু।
-চল ফিরে যাই।

ভেতরে ধক করে উঠল; মানে একসাথে বৃষ্টিতে হাঁটা কি শেষ! বাসা অবধি যাব না একসাথে। মনে মনে প্রশ্ন করে বসলাম। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলাম না।

-কি হল, চল।
-হ্যাঁ, যাচ্ছি।

বাসায় ফিরে ভেজা কাপড় ছেড়ে গা এলিয়ে বসলাম বারান্দায়। মুখের কাছে সরে আসা চুল হাত দিয়ে বিদায় করতে করতে কি সুন্দর একটা গন্ধ পেলাম নাকের কাছে; বকুল ফুল। উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের তাকে রাখা ফুলের মালাটা এলো খোঁপায় জড়িয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে এইতো অনি। আমায় যেন নিজে পরিয়ে দিল মালাটা। ধূসর ভাবনায় হঠাৎ মিলিয়ে গেল। আমিও ডায়েরির ভাজে রেখে দিলাম সুগন্ধভরা মালাখানি।

আজ ১৪-৬-২০২০। দিন চারেক পর মালাটা এখানে রাখার দু'বছর পূর্ণ হবে। দু'বছরে ফুলগুলোর আকারের পরিবর্তন হলেও গন্ধ আমার কাছে এখনো তাজা। মনে হচ্ছে কেউ যেন আশার বাণী দিয়ে গেছে। সেই আশাতেই আজও গন্ধটা সৌরভ ছড়াচ্ছে। আগেই বলেছিলাম, প্রাকৃতিক দৃশ্য, অবয়ব, সবই মানবমনের সাথে এক সুতোয় গাঁথা। ফুলও তো প্রকৃতিরই দান।

দিনগুলো আর অলস লাগে না। কেমন জানি জড় পদার্থে পরিণত হয়েছি। অনেকটা চুপসে যাওয়া মানসিকতা। নিজেকে কেন জানি কেন্দ্রিভুত করে রেখেছি। কিন্তু মা বাবা কখনো সেটা বুঝেছে কিনা জানি না। বাবার সাথে তো দিনে তেমন কথা হয় না। সারাবেলা স্টাডিরুম, মিটিং, প্রজেক্ট এগুলোই। কিন্তু কাছে গেলে একদম সময় দেন না এমন না। মা আছে গানের ক্লাস, স্টুডেন্ট, মহিলা সমিতির বিভিন্ন কাজে। এখন তার ব্যস্ততা অনেকটা কম। সেক্রেটারি সব গুছিয়ে নেন। মা একটু দিক নির্দেশনা দিলেই হয়। আমি ভার্সিটি যাই, ক্লাস করি, কোর্সের প্রজেক্ট রেডি করি, এটুকুই। আর একলা নিরবতায় নিজের সঙ্গী নিজেই।

একটা ডাক পড়ল।
-হিয়া এদিকে আয় তো, তোর ফোন এসেছে।
-আসছি মা।

নিচে নেমে দেখি রিসিভার নামানো। মা কাজ করছেন। চশমাটা চোখে দিতে দিতে আমার দিকে না তাকিয়েই ইশারায় বললেন ফোন ধরতে।

আমি হ্যালো বলতে যাবো...
-হিয়া।

আমি আকাশ পাতাল চিন্তা করতে পারলাম না। ডাক শুনে মনে হচ্ছে কত বছরের অপেক্ষার পর কেউ চমকে দিয়ে ধারালো ছুরি বসিয়ে দিল বুকে। ঝরঝরিয়ে রক্ত পড়ছে, কিন্তু যন্ত্রণা আমি বুঝতে পারছি না। বিষে ভরা রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। আর পুরো দেহে শান্তির মোলায়েম অনুভূতি।

-চিনতে পারলি? হ্যালো... হ্যালো...

থমকে গিয়ে ঢোক গিলে বললাম, 

-হ্যাঁ, কেমন আছিস?
-ভালো, আমি দেশে ফিরছি পরশু। পরে রাজশাহী গিয়ে থাকব দু'দিন।

আরেকটা ঝটকা খেলাম। কিন্তু রক্তাক্ত ঘা এখন আর মনে হচ্ছে না। শ্রবনশক্তি অবশ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না। আর কি বলে যাব সেটাও বুঝে উঠতে পারছি না।

-কিরে বলছিস না কেন কিছু? হ্যালো... হ্যালো... হিয়া... হ্যালো, হিয়া আছিস লাইনে?
-ভালো লাগল শুনে আসছিস যে।
-আরে বাবা আসছি বললে তো সবাই খুশি হয়। আমি বলছি তুই কি ফ্রি আছিস? দেখা করব তোর সাথে। অবশ্য ফ্রি না থাকলেও তোকে দেখা করতেই হবে।

এমনভাবে জোর দিয়ে কথাটা বলল যেন হাজার বছরের দাবি রাখি আমি এ জোরটার। শিকল পড়া আমি কথা শুনতে বাধ্য যেন। 

-রাখছি। এসে কথা হবে, টাটা।
-হুম, বাই।

-কে রে ফোন দিল?
মায়ের প্রশ্নে চেতন ফিরে পেলাম।

-না, ওই অনি আরকি।
-ওহ। গত না তার আগের বছরই না কানাডা গেল। বেশ ভালো খাটাখাটনি করেছে, মেধা ধরে অনেক।
-হুম।
-তা কি বলল; প্রশ্নটা করার আগেই আমি বলে দিলাম, 'মা ঘরে গেলাম, কিছু লাগলে ডেকে নিও।'
-আচ্ছা।

সিড়িতে পা দিয়ে উঠতে লাগলাম আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে কিছু একটা পাওয়া না পাওয়ার অনেকগুলো ধাপ এগোচ্ছি। আদৌ পাবার কোন আশা আছে কি। সা সংশয়ে আছি। সামনের সোপানগুলো আরো বেঁকে যাচ্ছে। আর আমিও হেলছি।

ঘরে গিয়ে ডায়েরিটা নিলাম। চিঠির ভাজ খুলে পড়তে শুরু করলাম।

...প্রিয় হিয়ারানী...
কি করছিস? অপেক্ষা?

এর বেশি পড়তে পারিনি, রেখে দিলাম। "অপেক্ষা" শব্দেই বিশাল ক্লান্তি আমার। এক টুকরো কাগজের চিঠির ভার এত কেন নিজেই বুঝি না। ভেতরটাও ভারী হয়ে আসে। আর পাঁজরের প্রতিটা কোণায় "অপেক্ষা" কথাটার প্রতিধ্বনি বাজতে থাকে। 

ডায়েরিটা বালিশের উপর রেখে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। এটাই কি আমি। আমি কি আমার হিয়াকে দেখতে পাচ্ছি? দু'বছর না, গত তিনটা বছর ধরে নিজের ভেতরের আমিটাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করিনি। ধূসর চোখে একটা বাড়ানো হাতে একটা মলিন বকুল ফুলের মালার ছবি দেখছি। 

চোখের কোণা থেকে এক ফোঁটা পানি ঝড়ল। নিচে বসে সেই ফোঁটার মধ্যে তাকিয়ে রইলাম; একটা সাগর দেখতে পাচ্ছি, সাগরের তীরে বেদনার নীল শাড়ি পড়ে একা হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে হাতটা ঝাপটে ধরল একটা হাত। অনি!

''কোথায় যাচ্ছিস?
চল বালুকাবেলায় একসাথে হাঁটি
একসাথে দেখব সূর্যের বাড়ি ফেরা।''

মুখফুটে বলতে পারলাম না কিছু। কাঁধে মাথা জড়িয়ে দেখতে থাকলাম পশ্চিম আকাশে লালচে আভা মিশে গেল পুরো আকাশে। ঢেউয়ের হাওয়া মন শীতল করে দিল।

আমার দোষ এটাই কাউকে কিছু বলতে পারিনা। নিজের মনের কথাগুলো নিজের মধ্যেই ডালপালা গজিয়ে ওঠে। তার প্রতিটি পাতায় আলাদা আলাদা ছন্দ। ছন্দ আলাদা হলেও গাছের মূল কান্ড একটাই। যার ছায়াতলে বসে আজ আমি কি যেন পাওয়ার আশায় পথ চেয়ে আছি।

একটা হালকা নীল রংয়ের থ্রিপিস পড়লাম। কপালে ছোট কালো টিপ। নীল রঙ অনির প্রিয়। আর কি কি ওর প্রিয় সেটা সবই প্রায় আমার জানা। কিন্তু আমি কি অনির প্রিয়? এটা আজও জানা হল না। জানতে চাওয়ার চেষ্টাও যে করিনি তা নয়। কিন্তু আমিতো ভেতরমনা। আমার ভেতরেই রয়ে গেছে সেটার উত্তর। আচ্ছা অনি কি সেটা বুঝতে পারে? নাকি আমাকেও বুঝে না।

বেরিয়ে যাব। মা বলল, ছাতা নিয়ে যা; মেঘ কালো করেছে। নেয়ার ইচ্ছে ছিল না। মায়ের জোরাজুরিতে নিলাম ছাতা।

কাজলা গেট পার করে হাঁটতে থাকলাম। কি জানি প্রতিটি কদমে আজ "অপেক্ষা" নামক শব্দ ধপ ধপ করে বাড়ছে। সময় কি বাড়ছে না কমছে সেটাও মনে হচ্ছে না। পাশ দিয়ে ঝরের গতিতে একটি কালো রঙের গাড়ি এসে থামল। শিউরে উঠলাম। মুখ ঝামটা দেবার আগের মুহুর্তেই কপাল কুঁচ হয়ে যায়। আর বলার আগেই বেরিয়ে এল অনি। বোবা হয়ে গেলাম। বোবা দৃষ্টি আমার। বোবা অনুভুতি। মাথায় চাটি মেরে বলল,

-কিরে হিয়ারানী। বেশ পন্ডিত হয়েছিস হয়েছিস লাগে। 
-কেমন আছিস?
-বাহ, ফরমালিটি দেখাচ্ছিস নাকি। হেসে উঠল অনি।
-ফরমালিটি দেখাবো কেন। সে দায় তো আমার না। তা ভালো গাড়ি কিনেছিস। বেশ বেশ।
-হ্যাঁ, কিনে ফেললাম। হ্যারে তোর মধ্যে দু'বছরে পরিবর্তন তো দেখলাম না।

নিজের ভেতরের নিজেকে প্রশ্ন করলাম 'একই আছি?' আমার ভেতরের পরিবর্তন বোধহয় এতদিন পরে আর প্রকাশিত হচ্ছে না। কি অদ্ভুত!

-চল তোকে নিয়ে ঘুরতে যাই। অনেকদিন দেশের মাটির হাওয়া লাগে না।
-কেন হাওয়া লাগিয়েইতো ঘুরে এলি।
-আরে ওগুলো সব গুমোট হাওয়া, বিষাক্ত। আর এখন কি তুই আছিস তো; এয়ারফ্রেশনার। চলতো কথা বাড়াস নে।

ঠিক আগের মতো হাতে টান দিয়ে বলল, 

-বস ভেতরে, আজকে শহর ঘুরব।

আমি কথা না বলে মুচকি হেসে বসলাম।

-গুড গার্ল।'

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পর একের পর এক কথা শুনে যাচ্ছি ওর; বিদেশের কথা, কাজের চাপ, সাফল্য। খুব ভালো লাগছে। কাছের মানুষের ছোট বড় সব এচিভমেন্টই খুব প্রশান্তি দেয়।

আরেকটা প্রশ্ন 'কাছের মানুষ?' অনিকে মনের অজান্তে কাছের মানুষ বলে দিলাম? আচ্ছা, ও কি ভাবে আমায় ওর কাছের মানুষ?

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শহরের রাস্তা ছেড়ে খোলা রাস্তায় এসে গাড়ি চলছে। কাঁচ নামিয়ে দিলাম। ঝাপটা লাগছে মুখে শীতল অনুভুতি। ভেজা মাটির গন্ধে আজ বকুল ফুলেরই গন্ধ মিশে।

-ঠান্ডা লেগে যাবে।
-না লাগবে না, ঠান্ডা লাগার ভয়ে আজ গুটিয়ে নিলে নিজ বেদনাকে স্পর্শ করবো কীভাবে।
-ভিজবি?
আমি জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বললাম,
-হ্যাঁ।
অমনি গাড়ি থেমে গেল। অনি বাইরে বেরিয়ে বলল, 'আয় বাইরে।'

আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। বেরিয়ে গেলাম। সামনে সবুজ একটা মাঠ। কতগুলো বাচ্চা ছেলে ফুটবল খেলছে। অনি দৌড়ে গেল। বাচ্চাদের সাথে মিশে খেলতে লাগল। বরাবারের মতো চঞ্চল স্বভাবটা ওর রয়েই গেছে। মানুষ মনখোলা প্রফুল্ল হলে তাদের স্বভাব বদলায় না। আজ অনিকে দেখে খুব ভালো বুঝতে পারছি।

আমি উপরে তাকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাসে নিজের ভেতরের বিষাক্ত হাওয়া ছেড়ে দিয়ে মিশতে চাচ্ছি প্রকৃতিতে। বৃষ্টির সাথে নিজের দু'ফোঁটা অশ্রুও মিশিয়ে দিলাম। অনি দেখতে পায়নি। দেখলে হয়তো বকতো খুব। ওর চঞ্চলতা দেখে যাচ্ছি। হঠাৎ খেলা ছেড়ে এগিয়ে এল।

-অনেকদিন পর দেশের আমেজ পেয়ে নিজেকে আটকাতে পারলাম নারে।
মুচকি হাসলাম।
-কি রে হিয়া? বেশ সুন্দর লাগছে তোকে। নীলে মানায় ভালো।
-তাই!
-হ্যাঁ, নীল আর সবুজের একটা সীমানা থাকে জানিস তো...
-হ্যাঁ, জানি। সবুজের শেষ যেখানে নীলের শুরু সেখানে।
-যেমন এই মাঠ। সবুজে ঘেরা। সামনে নীল আকাশের সাথে মিলে গেছে। শুরু হয়েছে নীলের যাত্রা। যদিও এখন মেঘে ঢাকা কালো মেঘ সরে গেলেই আবার লুকিয়ে থাকা আসল সত্য প্রকাশিত হবে।
-বাহ, দারুন বলেছিস তো। সামনে কবি হবার সমূহ সম্ভাবনা দেখছি তোর।

একটু শব্দ করে হেসে উঠলাম।
-যাহ কি বলিস, এসব কিছু না।
দেখলাম আমার হাসির দিকে এখনো তাকিয়ে আছে অনি। চোখে চোখ পড়তে সামলে নিলাম নিজেকে। বলে উঠল, 
-চল বেশিক্ষণ ভিজলে কালকে হাসপাতালে শুতে হবে তোর। গাড়িতে ওঠ।

উঠে বসলাম সারা রাস্তা কথা হল খুব কম। বৃষ্টি দেখতে দেখতে চলে এলাম। বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,

-শোন, কাল পদ্মার পাড়ে যাবো। ক্লাস শেষে অপেক্ষা করিস।

আবারো অপেক্ষা...

-যাবি তো?
-হু, যাব।
-আচ্ছা যা, বাই।

কালো গাড়ি, কালো আঁধারে মিলিয়ে গেল। আমিও কিছুটা সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম।

ভেঁজা কাপড় ছেড়ে সন্ধ্যার পাখিদের ঘরে ফেরা দেখা হয়নি আজ। কিন্তু মনের ভেতরের পাখিটাকে কালো আঁধারে মিশে যেতে দেখেছি। টেবিলে বসে লাল কলমে কাগজে হিজিবিজি লিখে যাচ্ছি। লম্বা লম্বা দাগ টানছি। কাউকে কখনো চিঠি লেখা হয়নি, যা হয়েছিল সেটারও উত্তর পাইনি আজও। কিন্তু  ফিরতি চিঠির ভাষা আজও পড়তে পারিনি। 

পরদিন ক্লাস শেষ। দাঁড়িয়ে আছি। অনেক্ষন হল অনি এল না। ফোনও আনিনি আজ; চার্জ শেষ, বাসায় ভুলে ফেলে আসছি। অপেক্ষার প্রহর বরাবরের মতোই শেষ। অনি আজ আর আসেনি। ফিরে গেলাম নীড়ে ফেরা পাখির মতো। আজও হয়তো আসবে না, চঞ্চলতার মতো খামখেয়ালি ভাবটাও কি ধরে রেখেছে অনি। বিদেশে যাবার আগেও ক্লাস শেষে কত দাঁড়িয়েছি ওর অপেক্ষায়; আসেনি। আজ আর সেই অপেক্ষার কোন ক্লান্তি নেই; আমি অভ্যস্ত, চিরচেনা অপেক্ষার গ্রাসে তলিয়ে গেছি আমি।

ফোনে মেসেজ আসল। নোটিফিকেশন শব্দ শুনেই বুঝে গেলাম মেসেজের ভাষা; ''সরি হিয়া, জানিসই বরাবরের ভুলোমন। চাপে পড়ে গেছি। কাল মাস্ট দেখা হবে। সরিইইই।'' 

তাই, না পড়া চিঠিটার মতোই মেসেজটাও না পড়াই রইলো। সবইতে অভ্যস্ত আজ আমি।

কতশত বারের মতো এখনো খামখেয়ালি অনি। কিন্তু নিজের পরিবারে মা ছাড়া যখন কোন অবলম্বন ছিলো না, মাকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াসে ব্যস্ত। কি কি কঠিন দিন পার করেছে দেখেছি। টিউশনি করতো, পত্রিকা অফিসে লেখা জমা দিত; আমিও দিতাম, কিন্তু অনির চেষ্টা খুব বেশি। কতকত স্কলারশিপের চেষ্টা করেছে। সাইন্সের প্রতিটা বিষয়ে খুব ভালো দক্ষতা রাখত। কতকত লেখালিখিও করেছে। অবশেষে ওর লেখা একটা আর্টিক্যাল পাবলিশ হল; স্কলারশিপও পেয়ে গেল। চলেও গেল। আজ পড়াশুনা আর কর্মক্ষেত্র দু'দিকেই খুব উন্নতি করেছে। যাবার পর কথা হত মাঝে মাঝে। কিন্তু আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করল।

নিজের মনের কথা, ভেতরের অনুভুতি কখনো ওকে সবটা বলতে পারিনি। ওই যে আগেই বলেছি, আমি ভেতরমনা। সহজে কিছু প্রকাশ করতে পারি না। পাছে বন্ধুত্বটা ভেঙে যাক এই ভয়ে। আজও হয়তো পারব না ওকে সবটা বলতে। একটা চিঠি দিয়েছিলাম অনেক সাহস করে, কিন্তু সেটার উত্তর আসেনি কখনো। হয়তো আমাকে বললে আমি কষ্ট পেতাম সেজন্য মুখফুটে বলেনি কখনো। আমিও আর প্রসঙ্গ তুলিনি কখনো। ও বিদেশে যাবার পর আমার ঠিকানায় চিঠি আসে একটি। কিন্তু সে চিঠি আজও খুলে দেখার সাহস হয়নি। কারণ, যদি আমার আশার বাতিতে জল পড়ে নিভে যায়; সেই ভয়ে। গত ছ'মাসে কতবার হাতে নিয়েছি পড়ব বলে, কিন্তু সাহস এসেই কোথায় নিমিষে পালিয়ে যায়।

এলার্ম দেয়া ছিল ফোনে, হুট করে বেজে উঠল। বন্ধ করে দিলাম। হয়তো ঘুম যাবার কথা ছিল সে ভেবে দেয়া, কিন্তু নির্ঘুম এই আমি যে আর নিদ্রা যাই না। মেসেজটা চোখে পড়ল। কিন্তু যা ভেবেছিলাম সেরকম না। এই প্রথম হয়তো অনির বিষয়ে একটা ভাবনা আমাকে ছাড়িয়ে গেল। আজ লেখাটা আগের স্ট্রাকচারটাকে ছাড়িয়ে গেছে।


- কীভাবে নিবি কথাটা জানিনা হিয়া। কিন্তু তোর জন্য আমার মনের আবেগটা আগের মতোই রয়েছে। আমি তোকে চিঠি লিখেছিলাম। তুই হয়তো পড়েছিস কি পড়িসনি জানিনা। আর সেই চিঠির উত্তর কখনো পাইনি, নিজেও জানতে চাইনি। কারণ তোর মনের উপর স্বাধীনতা শুধু তোরই। আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য হয়তো তোর মনের মধ্যে আকুলতা আমারই মতো, কিন্তু চিঠির উত্তর না পেয়ে মুছড়ে পড়েছিলাম। এখন যতটা কাছাকাছি আছি সেটাও যদি হারিয়ে যায় সে ভয়ে তোকে প্রশ্ন করা হয়নি। সেই বকুলের মালাটা আজও রেখেছিস দেখলাম। পত্রিকা অফিসের সামনে দিয়েছিলাম যে...

মেসেজ পড়া থামিয়ে দিলাম। দৌড়ে গেলাম, ব্যাগ খুলে দেখি ডায়েরিটা নেই। বিছানায় বসে পড়লাম। আবারও মেসেজে মন দিলাম,

''কিরে কথাটা শুনে চমকে গেছিস। ডায়েরিটা খুঁজতে শুরু করেছিস। তোর ডায়েরি আমার কাছে। সেদিন গাড়িতে বেখেয়ালে ফেলে গেছিস। ভাগ্যিস ফেলে গিয়েছিলি, তোর এই বেখেয়ালি স্বভাবটার জন্য আজ মনের মধ্যে পুরনো ভালোবাসাটা আরেকটবার হাতছানি দিল।

আমার মনের সব কথা চিঠিতে লিখেছিলাম। কারণ তখন হয়তো তোর চোখ দেখে তোর মনের কথাটা পড়তে পেরেছিলাম। কিন্তু, আমার পরিস্থিতি ছিল অন্য; বুকে হাজার স্বপ্ন,  মাথার উপর কিছু দায়িত্ব। চাইলেও তখন তোর দিকে হাত বাড়াতে পারতাম না। সব জানিয়েছিলাম তোকে। হয়তো আমার মতো শঙ্কায় পড়ে তুইও পড়িসনি চিঠি। আমি ভেবেছিলাম সময় পাল্টে যাবে; আর তুইও পাল্টে যাবি। প্রণয়ের দিকে এগোবে না মনের ভেতরের আবেগটা।

কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তুই বদলাসনি। বৃষ্টির মতো তোর চোখেও বিচ্ছেদের করুণ ছবি ভেসে ওঠে। তোর বাড়িয়ে রাখা হাতটা আমি ধরতে চাই, সুযোগ দিবি তো আমায়...''


থেমে গেল আমার মেসেজ পড়া। মনের ভেতর হাজারটা প্রজাপতির ডানা ঝাপটানো বুঝতে পারছি, ঝড় উঠেছে যে কীভাবে থামাবো তা? আজ বুঝি মনের ভেতরে উথাল পাতাল হচ্ছে সব। এত বছর নিজের মধ্যে নিজের ভরসাটার সাথে লড়াই করেছি অনেক। সত্যিই কি হাত বাড়াচ্ছে অনি আমার দিকে, নাকি বাড়ানো হাতটা কালো গাড়ির মতোই ধূসর অন্ধকারে হারিয়ে যাবে... কল্পনা সব আমার!

সকাল সকাল রেডি হলাম। আজকে প্রজেক্ট জমা দিব। প্রজেক্ট জমা দেওয়ার তাড়া নেই মনে। তবুও কি যেন একটা থেকে ঘন্টা বাজাচ্ছে। কানে তালা লেগে যাচ্ছে সে আওয়াজে। কিন্তু তাও দু'হাতে তো কান চেপে ধরছি না। কি জানি চলছে একটা...

প্রজেক্ট শেষ করে বকুলতলা দিয়ে হাঁটছি। কি সুন্দর ফুলগুলো ঝরে থাকে। সাদা তারার মতো ছড়ানো। মনে হচ্ছে একরাশ নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে মাটিতে। তুলে নিয়ে অনুভব করলাম কিছু বকুলের সুবাস। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খুলতেই দেখি দূরে অনি দাঁড়িয়ে। একটা কালো টি-শার্ট পড়েছে। কালো রঙে ছেলেদের ভালোই মানায়। চিরচেনা এই রঙে বহুবার দেখেছি অনিকে। আজকে কেন জানি এক নতুন মানুষ লাগছে। এগিয়ে এল সামনে। ওর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন আমার ভেতরে ঠাস ঠাস শব্দে শব্দ হচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। কিন্তু কেন! আগে তো এমন অনুভুতি কখনো হয়নি...

-হাতটা দেখি?
-হু?
-বলছি হাতটা দে তোর। 
-বাধ্য শিশুরমতো বাড়ালাম।
-চোখ বন্ধ কর। 
-হু।
একটা ভারী কিছু অনুভব করলাম।
-চোখ খোল।
-ডায়েরি?
-হ্যাঁ, তোর ডায়েরি। তোর মনের কথা পড়তে না পারলে হয়তো আজও সব অধরাই থেকে যেত। 
-কিছু কিছু জিনিস অধরা থাকাই ভালো। এত বছর তো সব অধরাই ছিল। অনুভবে সব ছিল জীবন্ত, রঙিন।-
হুম, আজও আবার সব রঙিন হবে; হবে তুই যেমন চাইতি। 
-মানে?
মানে কিছুই না।

মাথা নিচু করে আছি। ডায়েরিটা বেখেয়ালে খুলে দেখলাম, একটি নতুন বকুল ফুলের মালা আর কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি। চোখ তুলে তাকাতেই দেখি অনি হাসছে। 

-পুরনোটা ফেলে দিয়েছি। পুরনো কেবল বেদনাই বাড়ায়।
কিরে পাগলি কাঁদছিস কেন?
ওই! কিরে...

এমন সময় হুরমুড়িয়ে বৃষ্টি শুরু। আমার অশ্রুজল আর বৃষ্টিজল মিশে যাচ্ছে। সকাল থেকেই যদিও আকাশ কালো ছিল। আমি আজও বেখেয়ালে ছাতা আনিনি। মাথার উপর ছাতা ধরল অনি। আর বকুল ফুলের ছড়ানো পথ ধরে এগিয়ে চললাম।

আজকের বৃষ্টি আর বৃষ্টি বকুল, সবাই নতুন সৌরভ দিচ্ছে। 

''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিল''

আজ আমি তারে পেয়েছি। তার বকুলের মালার মতো করে অনুভব করছি ঝরে পড়া বৃষ্টির ঝাপটা।

পৃথিবীর সবকিছুতে একটা সুর আছে; শুধু বুঝে নিতে হয়। আর নিজের ভেতরে থাকা সৌরভ সবসময় অনুভব করতে হয়। বাড়ানো হাত বাড়িয়ে রাখল ভরসার মানুষটি। একটা না একটা সময় ধরবে সে হাত। 

আর তখন ছড়াবে,

বকুলের মতো সুবাস আর ঝরবে অঝোরে মোহনীয় বৃষ্টি।


সাদিয়া প্রমি
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

আপনার মতামত লিখুন :


‘অপেক্ষার বৃষ্টি বকুল’।। সাদিয়া প্রমি। গল্প

নিউজরুম ডেস্ক সোমবার, ২৭ জুলাই ২০২০ ইং ১৩:৫৮ NewsRoom


জ অনেক দিন পর ডায়েরির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বকুল ফুলের চেপ্টে যাওয়া পুরনো একটা মালা। একটু শুঁকে দেখলাম গন্ধটা আছে এখনো। ফুলের মালাটা উঠাতেই পরের পৃষ্ঠায় একটি চিঠি আর একটা তারিখ লেখা; ১৮-৬-২০১৮। চিঠির ভাজ খুলতেই দরজায় কড়া নেড়ে উঠল। ডায়েরিটা ড্রয়ারে রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখি গরম গরম চিড়ে ভাজা নিয়ে মা বলল, এই বৃষ্টির দিনে চিড়ে ভাজার কোন জবাব নেই।

একমুঠো চিড়ে হাতে নিয়ে মাকে বললাম, 
-আজ আষাঢ়ের কত তারিখ গো? 
মা বলল,
-দাঁড়া খবরের কাগজে দেখি। সঠিক খেয়াল নেই। 
চোখের চশমাটা ঠিক করে কাগজ দেখে মা বলল, 
-৬ তারিখ। 
আমার দিকে তাকিয়ে মা জানতে চাইল, হঠাৎ কেন বাংলা মাসের তারিখ জানতে চাইলাম।
-একটু হেঁসে বললাম, তেমন কিছুনা, এমনি।

বাসায় আজ আমি আর মা। বাবা বাইরে গেছে অফিসের কাজে। চিড়ে খাওয়া আর সঙ্গে এদিক-ওদিকের গল্প করতে করতে বাবা চলে এল।

-কি বাবা, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে আজ?
বাবা বলল, 
-হ্যাঁ, চলে এলাম আজ।

মা চলে গেল চিড়ের প্লেট নিয়ে। আমি ডায়েরিটা নিয়ে আবার বসলাম। চিঠিটার ভাঁজ না খুলে পড়তে আর ইচ্ছা হল না। গত ছয় মাসে কতবার যে খুলেছি চিঠিটা, পড়ার আর ইচ্ছেই নেই এখন।

মা বলল, আজ আষাঢ়ের ৬ তারিখ। আর কয়েকটা দিন গেলেই শ্রাবনের দিন আসবে; বর্ষার আসল রুপ তখন বোঝা যাবে। অবিরাম বৃষ্টি ঝরবে, হয়তো টানা দু'চারদিন। 

এইতো গত পরশু বাসায় আসার সময় ঝুম বৃষ্টি নামল। রিকশা পাইনি, ভিজতে হয়েছিল। বাসায় আসার পর মা ইচ্ছেমতো বকেছিল। অবশ্য বকারই কথা; যাবার সময় বার বার বলেছিল ছাতা নিয়ে যেতে, কিন্তু আমি নেইনি। যাক মায়ের বকা খাবার পর্ব শেষে কোনমতে একটু ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে আছি। ইয়ারফোনে গান বাজছে... 

 ''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি,
তোমায় দেখতে আমি পাইনি''

আজকের বৃষ্টিটা অন্যরকম। সকাল থেকেই থেমে থেমে ঝরছে। যখন ঝরে একটানা অনেকক্ষণ, আবার থামে; কিছুক্ষণ পর আবার। এ যেন হঠাৎ মন খারাপে ফুঁপিয়ে কাঁদা, সান্ত্বনায় থেমে যাওয়া নিরবতা; ব্যাথায় কাতরে উঠলে আরেক পশলা ঝরে পড়া কান্নার মতো। এজন্যই হয়তো কবিরা কবিতা বা বিভিন্ন লেখায় বলেছেন, প্রকৃতিমন আর মানবমন এক। মানব মনের বয়ে চলা চিন্তাধারা প্রকৃতির মাঝেই বিরাজমান।

একজন কবি বা গীতিকার কতো সুন্দর করেই না লিখেন। মনের সব ভাব প্রকাশ পায় তার কলমে। মনে হয় জগতের সব আকুলতা বের করে স্থান দিচ্ছেন গানের খাতায়। কি সুন্দর লাইন তাই না!

''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে''

লুকিয়ে রাখা সবকিছু আজকাল আমরা লুকাতে পারি না। সময়ের তাগিদে বা কোন এক ঝড়ে মনের আবেগে তাকে বের করতে হয়; সে যখন চলে যায় হৃদয় নিংড়ানো সব অনুভুতি তার দিকে ছুটে। আমরা বসে থাকি খালি হাতে। হিয়ার মাঝে কথাটাতে নিজের হিয়াকেই শূণ্য লাগে। খাঁচা ছাড়া পাখি মনে হয় না নিজেকে; আবদ্ধ লাগে। 

চোখ দুটো বুঝে আছি। আবারো বৃষ্টিতে আনমনা হয়ে কষ্ট নিয়ে ভাবছি, ফেলে আসা কোন এক স্মৃতি আর হিয়ার মধ্যে থাকা লুকোনো অনুভুতিকে জড়ো করতে। বৃষ্টির ছোঁয়াতে যদি একটু সজীব হয় তারা।

টেলিফোন বাজছিলো। রিসিভ করতেই অপরিচিত গলা। এই অপরিচিত গলাই আজ চরম পরিচিত। পরিচিত হয়েও হারিয়ে বেড়াচ্ছে অপরিচিতদের আঙিনায়।

-কি করছিস?
-কিছু না, বসে বসে বৃষ্টি দেখি; তুই?
-আমিও বৃষ্টিতে মিশিয়ে দিচ্ছি ক্লান্তিগুলো।
-ও…
-বের হবি কাল? পত্রিকা অফিসের লেখাটা আজ  জমা দিতে বলেছিল। ফোন দিয়ে বললাম বৃষ্টি অনেক কালকে আসি। উনারাও কালকের কথা বলল। তো বের হবিতো কাল..? হিয়া... শুনছিস?
-শুনছি, বল। দেখি কাল আসুক আগে।
-আচ্ছা।
-টেক কেয়ার, বাই।
-বাই।

কথা শেষ। রিসিভার রেখে আবারো বসলাম বৃষ্টি বিলাসে। ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে মুক্তোর দানা।

পত্রিকা অফিস যাব। বাইরে কালকের মতো বৃষ্টি না হলেও ইলশে গুড়ি বেশ ভালোই। ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। বের হবার সময় মা ছাতা ধরিয়ে দিলো আজ।

-হিয়া...

পিছন ফিরে দেখি অনিমেষ। একটা কালচে টি-শার্ট পড়েছে। যার অর্ধেকটাই বৃষ্টিতে ভিজে চিপচিপে হয়ে গেছে। হাতে একটা সবুজ শপিং ব্যাগ, আরেক হাতে ছাতা। বোধহয় আমারই মতো রিকশা পায়নি। ফোন দিয়ে নিজে ডাকলো বলে আসলাম, নইলে বিনা ডাকে সাড়া দেবার ইচ্ছা মরে গেছে বহু আগেই।

-দেরি হলো নাকি খুব?
-না ঠিক আছে, খুব একটা না। দেরি হলেও কি, অভ্যেস আছে।

একটু হেসে দিল। ছাতার পর্দায় টুক টুক বৃষ্টি ফোটার শব্দ আর অনির খিলখিলে হাসি। কেমন যেন এক সুন্দর মেলবন্ধন। হাসলে অনির গালে টোল পড়ে। সব ছেলেদের হয়তো সেটা থাকে না। খুব কম।

-কি? কই হারায় গেলি আবার।
-না, কিছু না। আচ্ছা শোন, রিকশা তো পাব না; হেঁটে যাব?
-হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে ভেজার চেয়ে হেঁটে রাস্তা কমানো ভালো। এইতো বড় রাস্তার উপর দিয়ে ১০ মিনিট হাঁটার পর পাশের ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পেরোলেই কাছেই। চলো পা চালাই।

হাঁটতে শুরু করলাম। বিদ্যুতের খুঁটির পাশে দাঁড় করানো ভ্যানে বসে আছে দুটো কাক। সকাল সকাল বৃষ্টিবিলাস বুঝি ওরাও করে। আমরা হেঁটে কাছে যেতে যেতে উড়ে গেল।

-আমি আজ ঘুম থেকে উঠেই অফিসে ফোন দিয়ে বলেছি আজকে আসব। সম্পাদক সাহেব যেন থাকে। তার সাথে কিছু কথা বলব।
-কি নিয়ে? 
-শোন হিয়া, সম্পাদকের যদি সময় হয়, উনি যদি ওনার কলামে আমাদের নিয়মিত করে নেন, তাহলে কাজ অনেক এগোবে।
-আমরা আমাদের মতো করে কাজটা উপস্থাপন করতে পারব, তাই না?
-হুম।

গত একমাস চলমান ঘটনাগুলোর উপর আমরা বিভিন্ন লেখা লিখছি। মোটামুটি একটা আর্টিকেলের মতো বেশ কবার ছেপে বের হয়েছে। লেখার মান ভালো হচ্ছে বলে পত্রিকা অফিস থেকে আবার ফোন দিয়ে ডেকেছে। অনির এক বন্ধু আছে ওখানে। তার সুবাদেই সব পাওয়া হচ্ছে।

অফিসে প্রায় এসে গেছি। বৃষ্টিতে ভেজা হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়ে এল, হাতে কতগুলো বকুল ফুলের মালা।

-আপা নিবেন, কেবল বানাইছি। কি যে বাসনা। লন, দেহেন দেহেন।

মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে অনি বলল, দেতো দুটো। মেয়েটি অবাক হল না, মনে হচ্ছে সে জানতো অনি মালা নিবে। বলার সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে দিল। অনি ভেজা পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিতেই খুশিতে চকচক করে উঠল মেয়েটি। প্রাণখোলা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। 

আমি কিছু বলার আগেই আমার হাতে মালা দিয়ে বলে উঠল,

-নে রাখ, বকুল তোর পছন্দের না; রাখ।
-চল যাই ভেতরে।
আমি অবাক হইনি। কিন্তু কেন হইনি সেটা নিজেও জানি না।

অনির পেছন পেছন অফিসে গিয়ে কাজ সেরে ফেললাম। বের হব তখন আমায় বলল, 

-যাক কাজটা মিটে গেছে। টেনসনের কিছু নেই আর কি বল?
-হ্যাঁ, আপাতত কমল কিছু।
-চল ফিরে যাই।

ভেতরে ধক করে উঠল; মানে একসাথে বৃষ্টিতে হাঁটা কি শেষ! বাসা অবধি যাব না একসাথে। মনে মনে প্রশ্ন করে বসলাম। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলাম না।

-কি হল, চল।
-হ্যাঁ, যাচ্ছি।

বাসায় ফিরে ভেজা কাপড় ছেড়ে গা এলিয়ে বসলাম বারান্দায়। মুখের কাছে সরে আসা চুল হাত দিয়ে বিদায় করতে করতে কি সুন্দর একটা গন্ধ পেলাম নাকের কাছে; বকুল ফুল। উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের তাকে রাখা ফুলের মালাটা এলো খোঁপায় জড়িয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে এইতো অনি। আমায় যেন নিজে পরিয়ে দিল মালাটা। ধূসর ভাবনায় হঠাৎ মিলিয়ে গেল। আমিও ডায়েরির ভাজে রেখে দিলাম সুগন্ধভরা মালাখানি।

আজ ১৪-৬-২০২০। দিন চারেক পর মালাটা এখানে রাখার দু'বছর পূর্ণ হবে। দু'বছরে ফুলগুলোর আকারের পরিবর্তন হলেও গন্ধ আমার কাছে এখনো তাজা। মনে হচ্ছে কেউ যেন আশার বাণী দিয়ে গেছে। সেই আশাতেই আজও গন্ধটা সৌরভ ছড়াচ্ছে। আগেই বলেছিলাম, প্রাকৃতিক দৃশ্য, অবয়ব, সবই মানবমনের সাথে এক সুতোয় গাঁথা। ফুলও তো প্রকৃতিরই দান।

দিনগুলো আর অলস লাগে না। কেমন জানি জড় পদার্থে পরিণত হয়েছি। অনেকটা চুপসে যাওয়া মানসিকতা। নিজেকে কেন জানি কেন্দ্রিভুত করে রেখেছি। কিন্তু মা বাবা কখনো সেটা বুঝেছে কিনা জানি না। বাবার সাথে তো দিনে তেমন কথা হয় না। সারাবেলা স্টাডিরুম, মিটিং, প্রজেক্ট এগুলোই। কিন্তু কাছে গেলে একদম সময় দেন না এমন না। মা আছে গানের ক্লাস, স্টুডেন্ট, মহিলা সমিতির বিভিন্ন কাজে। এখন তার ব্যস্ততা অনেকটা কম। সেক্রেটারি সব গুছিয়ে নেন। মা একটু দিক নির্দেশনা দিলেই হয়। আমি ভার্সিটি যাই, ক্লাস করি, কোর্সের প্রজেক্ট রেডি করি, এটুকুই। আর একলা নিরবতায় নিজের সঙ্গী নিজেই।

একটা ডাক পড়ল।
-হিয়া এদিকে আয় তো, তোর ফোন এসেছে।
-আসছি মা।

নিচে নেমে দেখি রিসিভার নামানো। মা কাজ করছেন। চশমাটা চোখে দিতে দিতে আমার দিকে না তাকিয়েই ইশারায় বললেন ফোন ধরতে।

আমি হ্যালো বলতে যাবো...
-হিয়া।

আমি আকাশ পাতাল চিন্তা করতে পারলাম না। ডাক শুনে মনে হচ্ছে কত বছরের অপেক্ষার পর কেউ চমকে দিয়ে ধারালো ছুরি বসিয়ে দিল বুকে। ঝরঝরিয়ে রক্ত পড়ছে, কিন্তু যন্ত্রণা আমি বুঝতে পারছি না। বিষে ভরা রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। আর পুরো দেহে শান্তির মোলায়েম অনুভূতি।

-চিনতে পারলি? হ্যালো... হ্যালো...

থমকে গিয়ে ঢোক গিলে বললাম, 

-হ্যাঁ, কেমন আছিস?
-ভালো, আমি দেশে ফিরছি পরশু। পরে রাজশাহী গিয়ে থাকব দু'দিন।

আরেকটা ঝটকা খেলাম। কিন্তু রক্তাক্ত ঘা এখন আর মনে হচ্ছে না। শ্রবনশক্তি অবশ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না। আর কি বলে যাব সেটাও বুঝে উঠতে পারছি না।

-কিরে বলছিস না কেন কিছু? হ্যালো... হ্যালো... হিয়া... হ্যালো, হিয়া আছিস লাইনে?
-ভালো লাগল শুনে আসছিস যে।
-আরে বাবা আসছি বললে তো সবাই খুশি হয়। আমি বলছি তুই কি ফ্রি আছিস? দেখা করব তোর সাথে। অবশ্য ফ্রি না থাকলেও তোকে দেখা করতেই হবে।

এমনভাবে জোর দিয়ে কথাটা বলল যেন হাজার বছরের দাবি রাখি আমি এ জোরটার। শিকল পড়া আমি কথা শুনতে বাধ্য যেন। 

-রাখছি। এসে কথা হবে, টাটা।
-হুম, বাই।

-কে রে ফোন দিল?
মায়ের প্রশ্নে চেতন ফিরে পেলাম।

-না, ওই অনি আরকি।
-ওহ। গত না তার আগের বছরই না কানাডা গেল। বেশ ভালো খাটাখাটনি করেছে, মেধা ধরে অনেক।
-হুম।
-তা কি বলল; প্রশ্নটা করার আগেই আমি বলে দিলাম, 'মা ঘরে গেলাম, কিছু লাগলে ডেকে নিও।'
-আচ্ছা।

সিড়িতে পা দিয়ে উঠতে লাগলাম আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে কিছু একটা পাওয়া না পাওয়ার অনেকগুলো ধাপ এগোচ্ছি। আদৌ পাবার কোন আশা আছে কি। সা সংশয়ে আছি। সামনের সোপানগুলো আরো বেঁকে যাচ্ছে। আর আমিও হেলছি।

ঘরে গিয়ে ডায়েরিটা নিলাম। চিঠির ভাজ খুলে পড়তে শুরু করলাম।

...প্রিয় হিয়ারানী...
কি করছিস? অপেক্ষা?

এর বেশি পড়তে পারিনি, রেখে দিলাম। "অপেক্ষা" শব্দেই বিশাল ক্লান্তি আমার। এক টুকরো কাগজের চিঠির ভার এত কেন নিজেই বুঝি না। ভেতরটাও ভারী হয়ে আসে। আর পাঁজরের প্রতিটা কোণায় "অপেক্ষা" কথাটার প্রতিধ্বনি বাজতে থাকে। 

ডায়েরিটা বালিশের উপর রেখে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। এটাই কি আমি। আমি কি আমার হিয়াকে দেখতে পাচ্ছি? দু'বছর না, গত তিনটা বছর ধরে নিজের ভেতরের আমিটাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করিনি। ধূসর চোখে একটা বাড়ানো হাতে একটা মলিন বকুল ফুলের মালার ছবি দেখছি। 

চোখের কোণা থেকে এক ফোঁটা পানি ঝড়ল। নিচে বসে সেই ফোঁটার মধ্যে তাকিয়ে রইলাম; একটা সাগর দেখতে পাচ্ছি, সাগরের তীরে বেদনার নীল শাড়ি পড়ে একা হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে হাতটা ঝাপটে ধরল একটা হাত। অনি!

''কোথায় যাচ্ছিস?
চল বালুকাবেলায় একসাথে হাঁটি
একসাথে দেখব সূর্যের বাড়ি ফেরা।''

মুখফুটে বলতে পারলাম না কিছু। কাঁধে মাথা জড়িয়ে দেখতে থাকলাম পশ্চিম আকাশে লালচে আভা মিশে গেল পুরো আকাশে। ঢেউয়ের হাওয়া মন শীতল করে দিল।

আমার দোষ এটাই কাউকে কিছু বলতে পারিনা। নিজের মনের কথাগুলো নিজের মধ্যেই ডালপালা গজিয়ে ওঠে। তার প্রতিটি পাতায় আলাদা আলাদা ছন্দ। ছন্দ আলাদা হলেও গাছের মূল কান্ড একটাই। যার ছায়াতলে বসে আজ আমি কি যেন পাওয়ার আশায় পথ চেয়ে আছি।

একটা হালকা নীল রংয়ের থ্রিপিস পড়লাম। কপালে ছোট কালো টিপ। নীল রঙ অনির প্রিয়। আর কি কি ওর প্রিয় সেটা সবই প্রায় আমার জানা। কিন্তু আমি কি অনির প্রিয়? এটা আজও জানা হল না। জানতে চাওয়ার চেষ্টাও যে করিনি তা নয়। কিন্তু আমিতো ভেতরমনা। আমার ভেতরেই রয়ে গেছে সেটার উত্তর। আচ্ছা অনি কি সেটা বুঝতে পারে? নাকি আমাকেও বুঝে না।

বেরিয়ে যাব। মা বলল, ছাতা নিয়ে যা; মেঘ কালো করেছে। নেয়ার ইচ্ছে ছিল না। মায়ের জোরাজুরিতে নিলাম ছাতা।

কাজলা গেট পার করে হাঁটতে থাকলাম। কি জানি প্রতিটি কদমে আজ "অপেক্ষা" নামক শব্দ ধপ ধপ করে বাড়ছে। সময় কি বাড়ছে না কমছে সেটাও মনে হচ্ছে না। পাশ দিয়ে ঝরের গতিতে একটি কালো রঙের গাড়ি এসে থামল। শিউরে উঠলাম। মুখ ঝামটা দেবার আগের মুহুর্তেই কপাল কুঁচ হয়ে যায়। আর বলার আগেই বেরিয়ে এল অনি। বোবা হয়ে গেলাম। বোবা দৃষ্টি আমার। বোবা অনুভুতি। মাথায় চাটি মেরে বলল,

-কিরে হিয়ারানী। বেশ পন্ডিত হয়েছিস হয়েছিস লাগে। 
-কেমন আছিস?
-বাহ, ফরমালিটি দেখাচ্ছিস নাকি। হেসে উঠল অনি।
-ফরমালিটি দেখাবো কেন। সে দায় তো আমার না। তা ভালো গাড়ি কিনেছিস। বেশ বেশ।
-হ্যাঁ, কিনে ফেললাম। হ্যারে তোর মধ্যে দু'বছরে পরিবর্তন তো দেখলাম না।

নিজের ভেতরের নিজেকে প্রশ্ন করলাম 'একই আছি?' আমার ভেতরের পরিবর্তন বোধহয় এতদিন পরে আর প্রকাশিত হচ্ছে না। কি অদ্ভুত!

-চল তোকে নিয়ে ঘুরতে যাই। অনেকদিন দেশের মাটির হাওয়া লাগে না।
-কেন হাওয়া লাগিয়েইতো ঘুরে এলি।
-আরে ওগুলো সব গুমোট হাওয়া, বিষাক্ত। আর এখন কি তুই আছিস তো; এয়ারফ্রেশনার। চলতো কথা বাড়াস নে।

ঠিক আগের মতো হাতে টান দিয়ে বলল, 

-বস ভেতরে, আজকে শহর ঘুরব।

আমি কথা না বলে মুচকি হেসে বসলাম।

-গুড গার্ল।'

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পর একের পর এক কথা শুনে যাচ্ছি ওর; বিদেশের কথা, কাজের চাপ, সাফল্য। খুব ভালো লাগছে। কাছের মানুষের ছোট বড় সব এচিভমেন্টই খুব প্রশান্তি দেয়।

আরেকটা প্রশ্ন 'কাছের মানুষ?' অনিকে মনের অজান্তে কাছের মানুষ বলে দিলাম? আচ্ছা, ও কি ভাবে আমায় ওর কাছের মানুষ?

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শহরের রাস্তা ছেড়ে খোলা রাস্তায় এসে গাড়ি চলছে। কাঁচ নামিয়ে দিলাম। ঝাপটা লাগছে মুখে শীতল অনুভুতি। ভেজা মাটির গন্ধে আজ বকুল ফুলেরই গন্ধ মিশে।

-ঠান্ডা লেগে যাবে।
-না লাগবে না, ঠান্ডা লাগার ভয়ে আজ গুটিয়ে নিলে নিজ বেদনাকে স্পর্শ করবো কীভাবে।
-ভিজবি?
আমি জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বললাম,
-হ্যাঁ।
অমনি গাড়ি থেমে গেল। অনি বাইরে বেরিয়ে বলল, 'আয় বাইরে।'

আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। বেরিয়ে গেলাম। সামনে সবুজ একটা মাঠ। কতগুলো বাচ্চা ছেলে ফুটবল খেলছে। অনি দৌড়ে গেল। বাচ্চাদের সাথে মিশে খেলতে লাগল। বরাবারের মতো চঞ্চল স্বভাবটা ওর রয়েই গেছে। মানুষ মনখোলা প্রফুল্ল হলে তাদের স্বভাব বদলায় না। আজ অনিকে দেখে খুব ভালো বুঝতে পারছি।

আমি উপরে তাকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাসে নিজের ভেতরের বিষাক্ত হাওয়া ছেড়ে দিয়ে মিশতে চাচ্ছি প্রকৃতিতে। বৃষ্টির সাথে নিজের দু'ফোঁটা অশ্রুও মিশিয়ে দিলাম। অনি দেখতে পায়নি। দেখলে হয়তো বকতো খুব। ওর চঞ্চলতা দেখে যাচ্ছি। হঠাৎ খেলা ছেড়ে এগিয়ে এল।

-অনেকদিন পর দেশের আমেজ পেয়ে নিজেকে আটকাতে পারলাম নারে।
মুচকি হাসলাম।
-কি রে হিয়া? বেশ সুন্দর লাগছে তোকে। নীলে মানায় ভালো।
-তাই!
-হ্যাঁ, নীল আর সবুজের একটা সীমানা থাকে জানিস তো...
-হ্যাঁ, জানি। সবুজের শেষ যেখানে নীলের শুরু সেখানে।
-যেমন এই মাঠ। সবুজে ঘেরা। সামনে নীল আকাশের সাথে মিলে গেছে। শুরু হয়েছে নীলের যাত্রা। যদিও এখন মেঘে ঢাকা কালো মেঘ সরে গেলেই আবার লুকিয়ে থাকা আসল সত্য প্রকাশিত হবে।
-বাহ, দারুন বলেছিস তো। সামনে কবি হবার সমূহ সম্ভাবনা দেখছি তোর।

একটু শব্দ করে হেসে উঠলাম।
-যাহ কি বলিস, এসব কিছু না।
দেখলাম আমার হাসির দিকে এখনো তাকিয়ে আছে অনি। চোখে চোখ পড়তে সামলে নিলাম নিজেকে। বলে উঠল, 
-চল বেশিক্ষণ ভিজলে কালকে হাসপাতালে শুতে হবে তোর। গাড়িতে ওঠ।

উঠে বসলাম সারা রাস্তা কথা হল খুব কম। বৃষ্টি দেখতে দেখতে চলে এলাম। বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,

-শোন, কাল পদ্মার পাড়ে যাবো। ক্লাস শেষে অপেক্ষা করিস।

আবারো অপেক্ষা...

-যাবি তো?
-হু, যাব।
-আচ্ছা যা, বাই।

কালো গাড়ি, কালো আঁধারে মিলিয়ে গেল। আমিও কিছুটা সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম।

ভেঁজা কাপড় ছেড়ে সন্ধ্যার পাখিদের ঘরে ফেরা দেখা হয়নি আজ। কিন্তু মনের ভেতরের পাখিটাকে কালো আঁধারে মিশে যেতে দেখেছি। টেবিলে বসে লাল কলমে কাগজে হিজিবিজি লিখে যাচ্ছি। লম্বা লম্বা দাগ টানছি। কাউকে কখনো চিঠি লেখা হয়নি, যা হয়েছিল সেটারও উত্তর পাইনি আজও। কিন্তু  ফিরতি চিঠির ভাষা আজও পড়তে পারিনি। 

পরদিন ক্লাস শেষ। দাঁড়িয়ে আছি। অনেক্ষন হল অনি এল না। ফোনও আনিনি আজ; চার্জ শেষ, বাসায় ভুলে ফেলে আসছি। অপেক্ষার প্রহর বরাবরের মতোই শেষ। অনি আজ আর আসেনি। ফিরে গেলাম নীড়ে ফেরা পাখির মতো। আজও হয়তো আসবে না, চঞ্চলতার মতো খামখেয়ালি ভাবটাও কি ধরে রেখেছে অনি। বিদেশে যাবার আগেও ক্লাস শেষে কত দাঁড়িয়েছি ওর অপেক্ষায়; আসেনি। আজ আর সেই অপেক্ষার কোন ক্লান্তি নেই; আমি অভ্যস্ত, চিরচেনা অপেক্ষার গ্রাসে তলিয়ে গেছি আমি।

ফোনে মেসেজ আসল। নোটিফিকেশন শব্দ শুনেই বুঝে গেলাম মেসেজের ভাষা; ''সরি হিয়া, জানিসই বরাবরের ভুলোমন। চাপে পড়ে গেছি। কাল মাস্ট দেখা হবে। সরিইইই।'' 

তাই, না পড়া চিঠিটার মতোই মেসেজটাও না পড়াই রইলো। সবইতে অভ্যস্ত আজ আমি।

কতশত বারের মতো এখনো খামখেয়ালি অনি। কিন্তু নিজের পরিবারে মা ছাড়া যখন কোন অবলম্বন ছিলো না, মাকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াসে ব্যস্ত। কি কি কঠিন দিন পার করেছে দেখেছি। টিউশনি করতো, পত্রিকা অফিসে লেখা জমা দিত; আমিও দিতাম, কিন্তু অনির চেষ্টা খুব বেশি। কতকত স্কলারশিপের চেষ্টা করেছে। সাইন্সের প্রতিটা বিষয়ে খুব ভালো দক্ষতা রাখত। কতকত লেখালিখিও করেছে। অবশেষে ওর লেখা একটা আর্টিক্যাল পাবলিশ হল; স্কলারশিপও পেয়ে গেল। চলেও গেল। আজ পড়াশুনা আর কর্মক্ষেত্র দু'দিকেই খুব উন্নতি করেছে। যাবার পর কথা হত মাঝে মাঝে। কিন্তু আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করল।

নিজের মনের কথা, ভেতরের অনুভুতি কখনো ওকে সবটা বলতে পারিনি। ওই যে আগেই বলেছি, আমি ভেতরমনা। সহজে কিছু প্রকাশ করতে পারি না। পাছে বন্ধুত্বটা ভেঙে যাক এই ভয়ে। আজও হয়তো পারব না ওকে সবটা বলতে। একটা চিঠি দিয়েছিলাম অনেক সাহস করে, কিন্তু সেটার উত্তর আসেনি কখনো। হয়তো আমাকে বললে আমি কষ্ট পেতাম সেজন্য মুখফুটে বলেনি কখনো। আমিও আর প্রসঙ্গ তুলিনি কখনো। ও বিদেশে যাবার পর আমার ঠিকানায় চিঠি আসে একটি। কিন্তু সে চিঠি আজও খুলে দেখার সাহস হয়নি। কারণ, যদি আমার আশার বাতিতে জল পড়ে নিভে যায়; সেই ভয়ে। গত ছ'মাসে কতবার হাতে নিয়েছি পড়ব বলে, কিন্তু সাহস এসেই কোথায় নিমিষে পালিয়ে যায়।

এলার্ম দেয়া ছিল ফোনে, হুট করে বেজে উঠল। বন্ধ করে দিলাম। হয়তো ঘুম যাবার কথা ছিল সে ভেবে দেয়া, কিন্তু নির্ঘুম এই আমি যে আর নিদ্রা যাই না। মেসেজটা চোখে পড়ল। কিন্তু যা ভেবেছিলাম সেরকম না। এই প্রথম হয়তো অনির বিষয়ে একটা ভাবনা আমাকে ছাড়িয়ে গেল। আজ লেখাটা আগের স্ট্রাকচারটাকে ছাড়িয়ে গেছে।


- কীভাবে নিবি কথাটা জানিনা হিয়া। কিন্তু তোর জন্য আমার মনের আবেগটা আগের মতোই রয়েছে। আমি তোকে চিঠি লিখেছিলাম। তুই হয়তো পড়েছিস কি পড়িসনি জানিনা। আর সেই চিঠির উত্তর কখনো পাইনি, নিজেও জানতে চাইনি। কারণ তোর মনের উপর স্বাধীনতা শুধু তোরই। আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য হয়তো তোর মনের মধ্যে আকুলতা আমারই মতো, কিন্তু চিঠির উত্তর না পেয়ে মুছড়ে পড়েছিলাম। এখন যতটা কাছাকাছি আছি সেটাও যদি হারিয়ে যায় সে ভয়ে তোকে প্রশ্ন করা হয়নি। সেই বকুলের মালাটা আজও রেখেছিস দেখলাম। পত্রিকা অফিসের সামনে দিয়েছিলাম যে...

মেসেজ পড়া থামিয়ে দিলাম। দৌড়ে গেলাম, ব্যাগ খুলে দেখি ডায়েরিটা নেই। বিছানায় বসে পড়লাম। আবারও মেসেজে মন দিলাম,

''কিরে কথাটা শুনে চমকে গেছিস। ডায়েরিটা খুঁজতে শুরু করেছিস। তোর ডায়েরি আমার কাছে। সেদিন গাড়িতে বেখেয়ালে ফেলে গেছিস। ভাগ্যিস ফেলে গিয়েছিলি, তোর এই বেখেয়ালি স্বভাবটার জন্য আজ মনের মধ্যে পুরনো ভালোবাসাটা আরেকটবার হাতছানি দিল।

আমার মনের সব কথা চিঠিতে লিখেছিলাম। কারণ তখন হয়তো তোর চোখ দেখে তোর মনের কথাটা পড়তে পেরেছিলাম। কিন্তু, আমার পরিস্থিতি ছিল অন্য; বুকে হাজার স্বপ্ন,  মাথার উপর কিছু দায়িত্ব। চাইলেও তখন তোর দিকে হাত বাড়াতে পারতাম না। সব জানিয়েছিলাম তোকে। হয়তো আমার মতো শঙ্কায় পড়ে তুইও পড়িসনি চিঠি। আমি ভেবেছিলাম সময় পাল্টে যাবে; আর তুইও পাল্টে যাবি। প্রণয়ের দিকে এগোবে না মনের ভেতরের আবেগটা।

কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তুই বদলাসনি। বৃষ্টির মতো তোর চোখেও বিচ্ছেদের করুণ ছবি ভেসে ওঠে। তোর বাড়িয়ে রাখা হাতটা আমি ধরতে চাই, সুযোগ দিবি তো আমায়...''


থেমে গেল আমার মেসেজ পড়া। মনের ভেতর হাজারটা প্রজাপতির ডানা ঝাপটানো বুঝতে পারছি, ঝড় উঠেছে যে কীভাবে থামাবো তা? আজ বুঝি মনের ভেতরে উথাল পাতাল হচ্ছে সব। এত বছর নিজের মধ্যে নিজের ভরসাটার সাথে লড়াই করেছি অনেক। সত্যিই কি হাত বাড়াচ্ছে অনি আমার দিকে, নাকি বাড়ানো হাতটা কালো গাড়ির মতোই ধূসর অন্ধকারে হারিয়ে যাবে... কল্পনা সব আমার!

সকাল সকাল রেডি হলাম। আজকে প্রজেক্ট জমা দিব। প্রজেক্ট জমা দেওয়ার তাড়া নেই মনে। তবুও কি যেন একটা থেকে ঘন্টা বাজাচ্ছে। কানে তালা লেগে যাচ্ছে সে আওয়াজে। কিন্তু তাও দু'হাতে তো কান চেপে ধরছি না। কি জানি চলছে একটা...

প্রজেক্ট শেষ করে বকুলতলা দিয়ে হাঁটছি। কি সুন্দর ফুলগুলো ঝরে থাকে। সাদা তারার মতো ছড়ানো। মনে হচ্ছে একরাশ নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে মাটিতে। তুলে নিয়ে অনুভব করলাম কিছু বকুলের সুবাস। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খুলতেই দেখি দূরে অনি দাঁড়িয়ে। একটা কালো টি-শার্ট পড়েছে। কালো রঙে ছেলেদের ভালোই মানায়। চিরচেনা এই রঙে বহুবার দেখেছি অনিকে। আজকে কেন জানি এক নতুন মানুষ লাগছে। এগিয়ে এল সামনে। ওর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন আমার ভেতরে ঠাস ঠাস শব্দে শব্দ হচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। কিন্তু কেন! আগে তো এমন অনুভুতি কখনো হয়নি...

-হাতটা দেখি?
-হু?
-বলছি হাতটা দে তোর। 
-বাধ্য শিশুরমতো বাড়ালাম।
-চোখ বন্ধ কর। 
-হু।
একটা ভারী কিছু অনুভব করলাম।
-চোখ খোল।
-ডায়েরি?
-হ্যাঁ, তোর ডায়েরি। তোর মনের কথা পড়তে না পারলে হয়তো আজও সব অধরাই থেকে যেত। 
-কিছু কিছু জিনিস অধরা থাকাই ভালো। এত বছর তো সব অধরাই ছিল। অনুভবে সব ছিল জীবন্ত, রঙিন।-
হুম, আজও আবার সব রঙিন হবে; হবে তুই যেমন চাইতি। 
-মানে?
মানে কিছুই না।

মাথা নিচু করে আছি। ডায়েরিটা বেখেয়ালে খুলে দেখলাম, একটি নতুন বকুল ফুলের মালা আর কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি। চোখ তুলে তাকাতেই দেখি অনি হাসছে। 

-পুরনোটা ফেলে দিয়েছি। পুরনো কেবল বেদনাই বাড়ায়।
কিরে পাগলি কাঁদছিস কেন?
ওই! কিরে...

এমন সময় হুরমুড়িয়ে বৃষ্টি শুরু। আমার অশ্রুজল আর বৃষ্টিজল মিশে যাচ্ছে। সকাল থেকেই যদিও আকাশ কালো ছিল। আমি আজও বেখেয়ালে ছাতা আনিনি। মাথার উপর ছাতা ধরল অনি। আর বকুল ফুলের ছড়ানো পথ ধরে এগিয়ে চললাম।

আজকের বৃষ্টি আর বৃষ্টি বকুল, সবাই নতুন সৌরভ দিচ্ছে। 

''আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিল''

আজ আমি তারে পেয়েছি। তার বকুলের মালার মতো করে অনুভব করছি ঝরে পড়া বৃষ্টির ঝাপটা।

পৃথিবীর সবকিছুতে একটা সুর আছে; শুধু বুঝে নিতে হয়। আর নিজের ভেতরে থাকা সৌরভ সবসময় অনুভব করতে হয়। বাড়ানো হাত বাড়িয়ে রাখল ভরসার মানুষটি। একটা না একটা সময় ধরবে সে হাত। 

আর তখন ছড়াবে,

বকুলের মতো সুবাস আর ঝরবে অঝোরে মোহনীয় বৃষ্টি।


সাদিয়া প্রমি
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

 


2020 All Rights Reserved | www.newsroombd.com.bd
+8801554927951 info@newsroom.com.bd